বাণিজ্যের আড়ালে পাচার ৬৪ হাজার কোটি টাকা
নিজস্ব প্রতিবেদক আপডেট: ২০২০-০৩-০৪ ০৯:০৬:৩৭
বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার বেড়েছে। কর ফাঁকি দিতে, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করতে, কোম্পানির মুনাফা লুকাতে এবং অন্যান্য কারণে পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে অনেকে সময় পণ্যের প্রকৃত মূল্য দেখানো হয় না। এভাবে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং বা কম মূল্য দেখানো এবং ওভার ইনভয়েসিং বা বেশি মূল্য দেখানোর কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের বছরে গড়ে ৭৫৩ কোটি ডলারের গরমিল রয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, এই অঙ্কের উল্লেখযোগ্য অংশ বাণিজ্যের আড়ালে পাচার হয়ে যেতে পারে। জিএফআই প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রসঙ্গত, জিএফআই হল ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবৈধ আর্থিক প্রবাহ বা মুদ্রা পাচার নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে থাকে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সঙ্গে অর্থ পাচার রোধে বিভিন্ন রকম পরামর্শ ও নীতিগত সহায়তা দিয়ে থাকে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) এক রিপোর্টে এমন প্রাক্কলন করা হয়েছে। জিএফআই মঙ্গলবার উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাণিজ্যসম্পর্কিত অবৈধ অর্থের প্রবাহ (২০০৮-২০১৭) শিরোনামের রিপোর্টে এ বিষয়ে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর মধ্যে সর্বশেষ ২০১৭ সালসহ তিন বছরের পরিসংখ্যান নেই। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও তথ্যের এমন ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশের সাত বছরের পরিসংখ্যানকে গড় করে বার্ষিক গরমিলের প্রাক্কলন করা হয়েছে।
ট্রেড মিসপ্রাইসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার বেশি হয় বলে জানান অর্থনীতির গবেষকরা। তারা বলছেন, রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং ও আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এটা হচ্ছে। এগুলো ধরার জন্য এনবিআরের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানো উচিত। অবৈধ যখন বলা হয়, তখন অর্থ আসা ও যাওয়া দুইয়ের ক্ষেত্রেই তা হতে পারে। আমাদের মতো দেশের ক্ষেত্রে যাচ্ছে বেশি, আসছে কম। অর্থ পাচারের পরিমাণ যা হয়েছে, তাতে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কথাই বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। এ প্রবণতা কমিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট আইনের প্রয়োগ ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
জিএফআই প্রতি বছর বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। গত বছরের জানুয়ারিতে জিএফআইর রিপোর্টে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অর্থ পাচার বিষয়ে বিভিন্ন দেশের ১০ বছরের প্রাক্কলিত পরিসংখ্যান ছিল। এতে উল্লেখ ছিল, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫৯১ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা ৫০ হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের আড়ালে বিদেশে পাচার হয়। অন্যদিকে, অন্য দেশ থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশে পাচার হয়ে আসে।
জিএফআইর এবারের রিপোর্ট একটু ভিন্ন ধরনের। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশ বছরওয়ারি তার বহির্বাণিজ্যের যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, এর সঙ্গে তার বাণিজ্য অংশীদারদের দেওয়া পরিসংখ্যানের বড় অঙ্কের পার্থক্য রয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, বাণিজ্যের আড়ালে কর ফাঁকি, মানি লন্ডারিংসহ নানা অপরাধ ঘটছে। জিএফআই বলেছে, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে ৩৬টি উন্নত দেশের মধ্যকার বাণিজ্যে এই মূল্য পার্থক্যের পরিমাণ ৮ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। আর সর্বশেষ ২০১৭ সালে যার পরিমাণ ৮১৮ বিলিয়ন ডলার। জিএফআই এক সময় বাণিজ্যের পাশাপাশি অন্য উপায়েও অর্থ পাচারের প্রাক্কলন করত। ২০১৪ সাল পর্যন্ত জিএফআইর পরিসংখ্যান সেই কেন্দ্রিক ছিল। ২০১৫ সালের প্রাক্কলনে তারা শুধু বাণিজ্যের আড়ালে পাচারের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে।
জাতিসংঘের কাছে পাঠানো সব দেশের আমদানিকারক ও রপ্তানির তথ্যের মধ্যে গরমিল বা অসামঞ্জস্যতা থেকে জিএফআই অর্থ পাচারের প্রাক্কলন করে। যদিও এর বাইরেও নানা প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার হয়। সেই বিচারে এবারের পরিসংখ্যানকে একটি দেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে অন্য দেশে অর্থ পাচার এবং একই সঙ্গে অন্য দেশ থেকে সেই দেশে পাচার হয়ে আসার মোট পরিমাণকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
জিএফআইর প্রতিবেদনে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মূল্য পার্থক্যকে একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ইকুয়েডর তার দেওয়া পরিসংখ্যানে যদি ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ২ কোটি ডলারের কলা রপ্তানি করেছে বলে উল্লেখ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির পরিসংখ্যানে যদি তা দেড় কোটি ডলার হয়, তাহলে মূল্য পার্থক্য দাঁড়াবে ৫০ লাখ ডলার। এভাবে সব দেশের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য বা মূল্য পার্থক্যের হিসাব করেছে জিএফআই।
জিএফআইর রিপোর্টে বলা হয়, উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বার্ষিক বাণিজ্যের ১৪ দশমিক ৬২ শতাংশ অর্থ আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এই হার ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫ হাজার ৯৯১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে আমদানি করেছে ৪ হাজার ৫৪ কোটি ডলারের পণ্য। মোট আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ স্থানীয় মুদ্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগের পরিবেশ নেই, যে কারণে টাকা পাচার হচ্ছে।
অনেকেই এ দেশে টাকা রাখা নিরাপদ মনে করেন না। ফলে টাকা বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। তার মতে, যন্ত্রপাতির মূল্য বেশি দেখিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ একবার বিদেশে টাকা গেলে, তা ফেরত আনা খুব কঠিন।
তিনি আরও বলেন, সরকার তার ভাবমূর্তি হারানোর ভয়ে তথ্য লুকিয়ে রাখে। কিন্তু এগুলো করে লাভ হয় না। কারণ ভাবমূর্তি শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয় না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, প্রতিষ্ঠানটি অর্থ পাচার সংক্রান্ত যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তা যাচাই করে দেখব। সাধারণত আমদানি-রফতানির আড়ালে অর্থ পাচার হয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল হোসেন জানান, নিশ্চিত ওইসব টাকা পাচার করা হয়েছে। যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো অনুমোদন নেই মালয়েশিয়ায় টাকা নেয়ার। তারপরও টাকা গেছে। বুঝতে অসুবিধা নেই যে, এই টাকা পাচার হয়েছে।