মু’মিনের জীবনে তাকওয়া

:: প্রকাশ: ২০২০-০৩-০৯ ০৭:২০:৫০


মহান আল্লাহ তা’লা মানব জাতিকে একমাত্র তাঁর ঈবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছেন। মানুষের হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে নবী রসুল প্রেরন করেছেন। তাঁরা মানুষকে হালাল, হারাম, বৈধ, অবৈধ, ভাল মন্দ, বিচার করে চলার জন্য তাগিদ দিয়েছেন।

অন্যায়, অবিচার ও অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহভীতির প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অপরিহার্য। এজন্য মানুষকে সৎ, যোগ্য আদর্শবান ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে হলে ত্বাকওয়ার বিকল্প নাই।

মুমিনের পরিচয়:
মুমিন আরবি শব্দ।এটি ঈমান শব্দ থেকে এসেছে। মুমিন শব্দের অর্থ যিনি ঈমান এনেছেন। কোন ব্যক্তির শুধু মৌখিক স্বীকৃতি মুমিন হিসাবে গন্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। আল্লাহ বলেন, “আর মানুষের মধ্যে এমন লোক আছে যারা বলে, আমরা আল্লাহর উপর এবং শেষ দিনের উপর ঈমান এনেছি, অথচ তারা মোটেই ঈমানদার নয়”। বাকারা- ৮।
রসুল (সঃ) বলেন, “ঈমান হলো তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহর প্রতি, শেষ দিবসের প্রতি, ফেরেশতাগনের প্রতি, কিতাবের প্রতি, নবীগনের প্রতি, মৃত্যু ও মৃত্যুর পরবর্তী পুনরায় হায়াত লাভের প্রতি। তুমি আরো বিশ্বাস করবে জান্নাত, জাহান্নামের হিসাব, নেকী বদীর ওজনের প্রতি, তাকদিরের ভাল মন্দের প্রতি। যখন তুমি এরূপ বিশ্বাস করবে তখন ভাববে যে তুমি ঈমান এনেছ”।“ মুসনাদে আহম্মদ : ২৯২৪”
কারো কথা বার্তা চাল চলন আচার ব্যবহার আমল আখলাক ইত্যাদি যদি ইসলামি আকিদা বিশ্বাসের ও ইসলামি অনুশাসন অনুযায়ী হয় তাহলে বুঝতে হবে লোকটি ঈমানদার।

মুমিনের গুনাবলী: 
(ক) অন্তরে আল্লাহ ভীতি থাকা, (খ) বিনয় ও নম্রতার সাথে চলাফেরা করা, (গ) খরচের মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা, (ঘ) যৌবন হেফাজত করা, (ঙ) আমানত সংরক্ষন করা, (চ) প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, (ছ) অনর্থক ক্রিয়া কর্ম থেকে বিরত থাকা, (জ) রাসুল (স:) এর প্রতি সর্বোচ্চ মহব্বত রাখা, (ঝ) পরের ব্যাথায় নিজেই ব্যথিত হওয়া, (ঞ) অন্যের জান মাল তার থেকে নিরাপদ থাকা, (ট) তওবা করা, (ঠ) অভুক্ত প্রতিবেশির প্রতি খেয়াল রাখা, (ড) সালাত কায়েম করা, (ঢ) সালাতে বিনয়ী থাকা, ইত্যাদি।

মু’মিনের জীবনে তাকওয়া

তাকওয়ার পরিচয়:
তাকওয়া আরবী শব্দ। তাকওয়া শব্দের অর্থ ভয় করা, সাবধান হয়ে চলা, বেঁচে থাকা (কোন কিছু থেকে), পরহেজগারি করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহর ভয়ে ও পরকালীন শাস্তির ভয়ে আল্লাহর আদেশ সমূহ পরিপালন করা ও নিষিদ্ধ সব ধরনের কাজ থেকে বেঁচে থাকাই তাকওয়া। যিনি বেঁচে থাকেন তাকে মুত্তাকী বলে।

তাকওয়ার উপমা:
ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) এর পশ্নের জবাবে উবাই ইবনে কাব (রাঃ) কাঁটা বনের ভেতরে কন্টকাকীর্ন পথে কোন পথিকের পথ চলা। দুনিয়া একটি কাঁটাবন শয়তান নানা অনৈতিক কাঁটা সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। যেমন কুফর, শিরক,নিফাক, বিদআত, মিথ্যা, প্রতারনা,অনৈতিকতা, সুদ,ঘুষ, দুর্নিতি, চুরি,অশ্লিলতা, ব্যভিচার,লোভ, হিংসা ইত্যাদি। মু’মিন সর্বদা তা থেকে বেচে থাকার চেষ্টা করে।

আল্লাহ বান্দাদের জন্য নবী রাসুলদের মাধ্যমে দুনিয়ার এই কাঁটাবনের ভিতর একটি সত্য সরল পথ তৈরি করেছেন। বান্দা আল্লাহর ভয়ে ও পরকালিন শাস্তির ভয়ে সব ধরনের মন্দ কাজ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সিরাতুল মুস্তাকিম ধরে এমন ভাবে দুনিয়ার জীবনে পথ চলবে যেন শয়তানের ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা কোন অনৈতিকতার কাঁটা তাকে স্পর্শ করতে না পারে। দুনিয়ায় এমন ভাবে পথ চলার নাম হল তাকওয়া এবং যিনি এভাবে পথ চলেন তাকে বলা হয় মুত্তাকী।

তাকওয়ার বাস্তব চিত্র:

তাকওয়া শুধু হাতে তাসবিহ মাথায় টুপি পাগড়ি, মুখে লম্বা দাড়ি,গায়ে লম্বা জামা এগুলো নয়। এগুলো সুন্নাহ ও মোস্তাহাব মাত্র। মুত্তাকী হতে হলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক ও অন্যান্য সকল বিষয় আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ মানতে হবে। যেমন পর্দা, সুদ,ঘুষ, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধ, দাওয়াতে দ্বীন, দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব ইত্যাদি পালনের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা।

মু’মিনের তাকওয়া কেমন হবে:
বাইন মাছ যেমন কাদার মধ্যে থাকা সত্যেও তার গায়ে কাদা লাগে না, এরকম মু’মিন সমাজে পাপ পঙ্কিলতা এবং আল্লাহর নাফরমানীর কলুষিত পরিবেশে বাস করা সত্বেও তিনি আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলেন। পরিবেশের সাথে গা ভাসিয়ে না দিয়ে তিনি আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে কলুষমুক্ত থাকেন। তিনি অকল্যান সমাজ শ্রোতের বিপরীতে চলেন এবং সমাজের ন্যায় ও কল্যানের শ্রোতধারা প্রবাহিত করেন।

তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতির সরূপ:
আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থেকে এবং রহমতের আশা রেখে তাঁর নির্দেশ সমুহ পালন করতঃ তার ক্ষমতা, সম্মান, মর্যাদা ও যে মানের সত্বা তাঁকে সেই মানের ভয় করাই হলো আল্লাহ ভীতির সরূপ ।

আল্লাহ বলেন,“ হে মুুমিনগন তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, ভয় করার মতো ভয় করো এবং মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরন করো না”। (আল ইমরান-১০২)

তাকওয়ার মৌলিক বিষয়:
ক) আল্লাহ ও তাঁর রসুলের(সঃ) আদেশ সমুহ পালন করা ও নিষেধ সমুহ এড়িয়ে চলা। খ) শিরক, বিদ’ত হতে বিরত থাকা। গ) এমন কাজ থেকে বিরত থাকা যা আল্লাহর স্মরনকে গাফিল করে দেয়।

তাকওয়ার স্তর সমুহ:
ইমাম গাজ্জালী (রহীঃ) গুনগত ও মানগত দিক দিয়ে তাকওয়াকে চারটি স্তরে বিভক্ত করেছেন। যেমন ক) শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত হারাম থেকে বেঁচে থাকা। খ) সন্দেহযুক্ত হালাল বস্তু পরিত্যাগ করা। গ) আল্লাহর ভয়ে অপ্রয়োজনীয় হালাল বস্তু বর্জন করা। ঘ) যে সকল হালাল বস্তু আল্লাহর ইবাদতে সহায়তা করে না তা বর্জন করা।

আল্লামা রাগিব ইস্পাহানী পরহেযগারীতাকে তিনটি স্তরে বিন্যাস করেছেন।
ক) ওয়াজিব:সকল প্রকার হারাম থেকে বেঁচে থাকা। ইহা সকল মানুষের জন্য ওয়াজিব।খ) মুস্তাহাব: সন্দেহপূর্ন বস্তু থেকে বেঁচে থাকা । এটা মধ্যম স্তরের পরোহেযগারিতা। গ) মাফযুুল: মুবাহ এবং স্বল্প প্রয়োজনীয় বস্তু থেকে বিরত থাকা। এটা সর্বোচ্চ স্তরের পরোহেযগারিতা।

মু’মিনের জীবনে তাকওয়ার গুরুত্ত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও ফযীলত:-

ক) তাকওয়া হেদায়াতের বাহন:
তাকওয়াবান ব্যক্তি আল্লাহর হেদায়াত তথা আল্লাহর সঠিক পথ লাভ করেন। আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না। কোরআন মোত্তাকীদের সঠিক রাস্তা দেখায়। আল্লাহ বলেন,“ইহা ওই গ্রন্থ যার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই ; মোত্তাকীদের জন্য এ গ্রন্থ পথ নির্দেশক ”। (বাকারা-২)

খ) তাকওয়া মর্যাদার মাপকাঠি:
আল্লাহর কাছে সে ব্যাক্তি অধীক মর্যাদাবান যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে অর্থাৎ মোত্তাকী ব্যক্তিই আল্লহর কাছে বেশি মর্যাদাবান।
আল্লাহ বলেন, “ নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাবান যে অধিক মোত্তাকী ।” (হুজরাত-১৩)

গ) সংকট উত্তরনে তাকওয়া:
মানুষ দুনিয়ায় বিপদে আপদে পতিত হয় ইহা আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। আল্লাহ বান্দাকে ভয়, লোকসান, ক্ষুধা, শস্যহানি ইত্যাদি, দিয়ে পরীক্ষা করেন। আবার আল্লাহই তার বান্দাকে সংকট থেকে উত্তরন করেন। মোত্তাকীকে আল্লাহ সংকট উত্তরনের একটি রাস্তা বের করে দেন।
আল্লাহ বলেন, “যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার নিষ্কৃতির ব্যবস্থা করে দেন ”। (তলাক – ২)

ঘ) অপ্রত্যাশিত রিয্ক/প্রাচুর্য লাভ:
আল্লাহ মোত্তাকী বান্দাকে প্রাচুর্য দান করেন। এমন ভাবে রিয্ক দেন যে বান্দা তা হিসাব বা কল্পনা করতে পারে না ।
আল্লাহ বলেন, “ আর তাকে তার ধারনাতীত উৎস থেকে রিয্ক দান করেন”। (তলাক – ৩)

ঙ)আমলের পরিশুদ্ধি,গুনাহ মাফ ও চড়ান্ত সাফল্য:
তাকওয়াকারীকে আল্লাহ তার আমল সমুহ ইসলাহ বা পরিশুদ্ধ করেন। আমল গ্রহনযোগ্য হওয়ার মতো আমল করার তাওফিক দান করেন। কারন পরিশুদ্ধ আমলই আল্লাহ গ্রহন করেন। আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগন আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্য বলো, তাহলে তিনি তোমাদের আমলকে ত্রুটি মুক্ত করবেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন। যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের (সঃ) আনুগত্য করে তারা অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করে।” (আহযাব ৭০-৭১)

চ) আল্লাহর ভালোবাসা লাভ, জান্নাত লাভ:
আল্লাহ মোত্তাকী বান্দাকে ভাল বাসেন। মোত্তাকী বান্দার জন্য দুনিয়ার কল্যান ও আখেরাতের নাজাত ও নিয়ামতের মধ্যে রাখার নিশ্চয়তা দেন। চুড়ান্ত সাফল্য মোত্তাকী বান্দার জন্য এবং জান্নাত দানের নিশ্চয়তা দেন। আল্লাহ বলেন, “মোত্তাকীরা জান্নাতে ভোগ বিলাসে থাকবে”। (তুর ১৭)

উৎসঃ
১) কোরানুল কারিম ২) সমকালীন খুতবা, ডঃ মোঃ মন্জুরুল ইসলাম, প্রথম সংস্করন- জুন ২০১৭, বাংলদেশ ইসলামিক ল রিসার্স এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার ঢাকা । ৩। জলালাইন।

মোঃ দীন ইসলাম মিঞা এফ সি এ
এম এ (ইসলামিক স্টাডিজ)
প্রিন্সিপাল- দারুল মোকাম মাদ্রাসা ঢাকা
চেয়ারম্যান-ইসলাম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন অব বেঙ্গল
এমিগো ১৪ স্কয়ার(লেভেল-১২), ৫৯/সি-৬১/সি, আসাদ এভিনিউ, মোহাম্মদপুর ঢাকা-১২০৭
ইমেইল: islamfca@gmail.com