কাঁচামাল আসায় শঙ্কা দূর হচ্ছে ওষুধ খাতের

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০৪-০৮ ০৬:২০:০৯


বিভিন্ন প্রকার ওষুধ তৈরির কাঁচামাল অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টের (এপিআই) প্রায় ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর সিংহভাগ এপিআই আসে চীন, ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে চীন ও ইউরোপ থেকে গত দেড় মাসের বেশি সময় কাঁচামাল আসা প্রায় বন্ধ ছিল। এতে সামনের দিনগুলোয় দেশে ওষুধের সংকট হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। তবে আশার কথা হচ্ছে, চীন এপিআই আমদানির এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) নেয়া শুরু করেছে। এলসির বিপরীতে সেটেলমেন্টও খুব দ্রুত করছে দেশটি। যেহেতু কাঁচামাল আসছে, তাই ওষুধের সংকট হবে না বলে জানিয়েছেন ওষুধ শিল্পসংশ্লিষ্টরা।

দেশের বাজারে ৫০টির কাছাকাছি ওষুধ তৈরি করছে ল্যাব এইড ফার্মাসিউটিক্যালস। এপিআই আমদানির জন্য গত মাসেই এলসি খুলতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানটি। চীন থেকে চলতি মাসেই ওই কাঁচামাল পাওয়ার আশা করছেন ল্যাব এইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এএম শামীম। তিনি বলেন, আমাদের কাছে প্রায় তিন মাসের কাঁচামাল মজুদ ছিল। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে বৈশ্বিক বাণিজ্য একরকম বন্ধ থাকার কারণে দেশটি কোনো ধরনের এলসি নিতে চাচ্ছিল না। তখন একটু চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল কপালে। গত মাসের মাঝামাঝি থেকেই চীন এলসি নেয়া শুরু করেছে। এমনকি গত মাসের শেষ দিক থেকেই এলসি সেটেলমেন্টও শুরু করেছে দেশটি। ফলে ওষুধ তৈরিতে কাঁচামালের সংকট হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই আর।

জানা গেছে, দেশের ওষুধ শিল্পের কাঁচামালের ২০ শতাংশ দেশীয় উৎস থেকে আসে। বাকি ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে প্রায় ৬৬ শতাংশ ওষুধ কোম্পানিগুলো সরাসরি আমদানি করে। বাকি ১৪ শতাংশ কাঁচামাল কিছু দেশীয় প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে আমদানি করে স্থানীয় সরবরাহকারী হিসেবে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে দিয়ে থাকে।

গত অর্থবছরে দেশে ৬০ কোটি ডলার বা প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার এপিআই আমদানি হয়েছে। আমদানীকৃত এপিআইয়ের বড় অংশই আসে চীন থেকে। বড় কোম্পানিগুলোর প্রায় ৪৭ শতাংশ কাঁচামাল আসে চীন থেকে। পাশাপাশি ভারত থেকে ৩৪, কোরিয়া থেকে ৬, জার্মানি থেকে ৫, ফ্রান্স থেকে ৪ ও ইতালি থেকে ২ শতাংশ এপিআই আমদানি করে থাকে ওষুধ কোম্পানিগুলো। কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার কারণে ভারত থেকে আমদানি স্বাভাবিক থাকলেও অন্য দেশগুলো থেকে ওষুধের কাঁচামাল আসা অনেকটা বন্ধ হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় আমদানিনির্ভর কাঁচামালপ্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় দেশের ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে। তবে সম্প্রতি এ অনিশ্চয়তা একটু একটু করে কাটতে শুরু করেছে। ল্যাব এইড, এসিআই হেলথকেয়ার লিমিটেডসহ বেশকিছু বড় প্রতিষ্ঠান এলসি খোলা ও সেটেলমেন্ট করতে পেরেছে। বেশকিছু বড় প্রতিষ্ঠান ইউরোপের দেশ থেকে শিগগিরই কাঁচামাল আমদানি করতে পারবে বলে আশা করছে।

এসিআই হেলথকেয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এম মহিবুজ জামান এ বিষয়ে বলেন, ওষুধ তৈরিতে কমপক্ষে দুই-তিন মাসের কাঁচামালের মজুদ রাখতে হয়। পাশাপাশি পাইপলাইনে তিন থেকে চার মাসের ওষুধ মজুদ থাকে। করোনার কারণে আমরা এলসি খুলতে পারছিলাম না। তবে আশার কথা হচ্ছে, বৈশ্বিক কাঁচামালের আমদানি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এখন পর্যন্ত কোনো উদ্বেগজনক পরিস্থিতি নজরে আসেনি। কাঁচামাল আসতে থাকায় সামনের দিনে কোনো ধরনের সংকটের সম্ভাবনা নেই। আমরা মুনাফা নিয়ে চিন্তিত নই। দেশের এ সংকটময় অবস্থায় ওষুধ সরবরাহ ঠিক রাখতে সব ধরনের উদ্যোগ নিয়ে যাচ্ছি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ‘ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি অব বাংলাদেশ: প্রসপেক্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ওষুধের বাজারের বার্ষিক প্রবৃৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ওষুধের বাজার ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। দেশের মানুষের ওষুধের চাহিদার প্রায় ৯৭ শতাংশ চাহিদা পূরণ করছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। পাশাপাশি বিশ্বের ১০০টি দেশে ওষুধ রফতানি করে এসব কোম্পানি। তাদের ওষুধের রফতানির বাজার ছাড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। যদিও গুরুত্বপূর্ণ এ রফতানি খাতটি এখনো আমদানীকৃত কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল।

ওষুধ শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজের (বিএপিআই) মহাসচিব এম শফিউজ্জামান বলেন, বিএপিআই প্রতিনিয়ত ওষুধের কাঁচামাল মজুদের তথ্য পর্যালোচনা করছে। কোথাও কোনো ধরনের বাধা কিংবা সংকট আছে কিনা সেটি দেখা হচ্ছে। বিকল্প বাজারগুলো কিংবা উৎসগুলোকে আমরা ব্যবহার করার নির্দেশনা দিচ্ছি। সরকারকে আমার প্রতিনিয়ত আপডেট দিয়ে রাখছি। প্রায় সব বড় প্রতিষ্ঠানেরই পর্যাপ্ত এপিআই মজুদ ছিল। পণ্যের ভিন্নতা অনুযায়ী মজুদের পরিমাণেও ভিন্নতা থাকে। করোনা পরিস্থিতি আমদানিতে সাময়িক সমস্যা দেখা দিলেও শিগগিরই এপিআই আসা শুরু হবে। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত মজুদ আছে। আশা করছি, জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ প্রয়োজনীয় কোনো ওষুধের সংকট হবে না।

দেশে প্রায় ২৭৩টি তালিকাভুক্ত কোম্পানি রয়েছে। তবে বর্তমানে পরিচালনায় আছে ২১৭টি কোম্পানি। কোম্পানিগুলো দেশে ও বিদেশে প্রায় ২৮ হাজার ৫০০ ওষুধ বিপণন করে। এর বাইরে হোমিওপ্যাথিক, ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও হারবাল কোম্পানি রয়েছে। ২০১৮ সালে দেশে ওষুধ বিক্রির পরিমাণ বিবেচনায় শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠান ছিল স্কয়ার, ইনসেপ্টা, বেক্সিমকো, অপসোনিন, রেনাটা, হেলথকেয়ার, এসিআই, এরিস্টোফার্ম, এসকেএফ ও একমি। শীর্ষ এ ১০ কোম্পানির দখলে রয়েছে বাজারের ৭০ শতাংশ। এর বাইরে ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল, ওরিয়ন, ল্যাবএইড, হাডসন, রেডিয়েন্ট, বিকন, অ্যাপেক্স, জেনারেল, গ্লোব, ওয়ান, নিপ্রো, স্যান্ডোজ ও জিস্কা ফার্মাও বাজারের উল্লেখযোগ্য অংশ দখলে রেখেছে। সারা দেশে ফার্মেসিগুলোর মাধ্যমে রোগীদের কাছে ওষুধ পৌঁছে দেয় এসব কোম্পানি।

বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির (বিসিডিএস) সাবেক পরিচালক জাকির হোসেন জানান, সারা দেশে ১ লাখ ২৫ হাজার নিবন্ধিত এবং প্রায় ১৮ হাজার অনিবন্ধিত ফার্মেসি দোকান রয়েছে। সরকারের নির্দেশে প্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার ফার্মেসি নিরবচ্ছিন্নভাবে ওষুধের চাহিদা মেটাতে দোকান খোলা রেখে কাজ করে যাচ্ছে। এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের ওষুধের ঘাটতি দেখা দেয়নি। চাহিদা মোতাবেক কোম্পানিগুলো ওষুধ দিয়ে যাচ্ছে।