মহামারি করোনা সংকট

চাপ বাড়ছে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায়

সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২০-০৪-১১ ০৭:৪৭:০৯


চীনের উহান থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাস সংকটের কারণে খাদ্যশস্য রফতানির গন্তব্য সীমিত করে দিয়েছে রোমানিয়া। জরুরি অবস্থা চলাকালে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর বাইরে অন্যত্র খাদ্য রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা আরোপিত থাকার জোর সম্ভাবনা রয়েছে বলে ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী লুডোভিচ ওরবানের বক্তব্য হলো, কিছু লোভী শস্য মালিকের কারণে আমি আমার দেশের নাগরিকদের খাদ্যশস্যের অভাবে ফেলে দিতে পারি না। যদি প্রয়োজন পড়ে, আমি রফতানি নিষিদ্ধ এবং প্রয়োজনে তা (খাদ্যশস্য) জব্দ করতে বদ্ধপরিকর।

বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদনকারী দেশগুলো যে নিজেদেরই খাদ্যশস্য সরবরাহের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত, বুখারেস্টের এ সিদ্ধান্ত তারই ইঙ্গিতবাহী। অন্যদিকে দেশে দেশে খাদ্যশস্য নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে আতঙ্কজনিত অস্বাভাবিক ক্রয়প্রবণতা। বন্দরগুলোতেও কার্যক্রম প্রায় স্থবির। এ অবস্থায় রফতানি নিষিদ্ধের মাধ্যমে অতীতে বৈশ্বিক খাদ্যশস্য সরবরাহ ব্যবস্থায় যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, তা-ই অনেক বড় ও বিস্তৃত আকারে দেখা দেয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

রোমানিয়ার মতো এতটা কঠোর পদক্ষেপ না নিলেও ভিয়েতনামও বর্তমানে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কায় চাল রফতানিতে নতুন সরবরাহ চুক্তিগুলোর ওপর সাময়িক স্থগিতাদেশ আরোপ করে রেখেছে। চালের আরেক বৃহৎ রফতানিকারক দেশ ভারতও এখন পণ্যটি রফতানি স্থগিত রেখেছে।

অন্যতম বৃহৎ গম রফতানিকারক দেশ কাজাখস্তান বর্তমানে পণ্যটি রফতানি সীমিত করে আনার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে দেশটি পেঁয়াজ, চিনি, সূর্যমুখী তেলের মতো পণ্য রফতানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখে। গত মাসে বিশ্বের বৃহত্তম গম রফতানিকারক দেশ রাশিয়াও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যশস্য রফতানির ওপর স্থগিতাদেশ আরোপ করে।

বিষয়টিকে খাদ্যশস্য রফতানিতে সংরক্ষণবাদের (প্রটেকশনিজম) ব্যাপক উত্থানের সূত্রপাত হিসেবে দেখছেন কিয়েভভিত্তিক ইউকেআর এগ্রো কনসাল্টের মহাপরিচালক সের্গেই ফিওফিলভ। তার মতে, এটি আসলে নতুন এক প্রবণতার সূচনা: খাদ্য সংরক্ষণবাদ। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়, খাদ্য সরবরাহ নিয়ে বড় আকারের শঙ্কা এরই মধ্যে বিদ্যমান।

বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘও। এ বিষয়ে বৈশ্বিক রাষ্ট্রপুঞ্জের বক্তব্য হলো, দেশগুলোর উচিত এখন ‘প্রতিবেশীদের ভিখারি বানানোর’ নীতি পরিহার করা। এদিকে সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে,  চলমান মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারাতে পারে। ব্যাঘাত ঘটতে পারে শ্রম ব্যবস্থায়। ফলে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার প্রকোপ অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই বেড়ে দ্বিগুণ হতে পারে।

এর আগে ২০০৭ সালেও বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার ধারাবাহিকতায় ভারত ও ভিয়েতনামসহ বেশ কয়েকটি দেশ খাদ্যশস্য রফতানির ওপর স্থগিতাদেশ আরোপ করে রেখেছিল। এর ধারাবাহিতায় উন্নয়নশীল বিশ্বের ক্রেতা দেশগুলোর খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতি সে সময়ের চেয়েও অনেক জোরালো ও জটিল। এ অবস্থায় অদূরভবিষ্যতে সংকটের মাত্রা কোথায় দাঁড়াতে পারে, তা নিয়ে অনেক ধরনের শঙ্কাজনক পূর্বাভাস রয়েছে। এর প্রতিটিরই ভাষ্য বেশ আতঙ্কজনক।

চলতি বছর চালসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্যের উদ্বৃত্ত উৎপাদনের পূর্বাভাস দিয়েছে এফএও। মার্চের মাঝামাঝিতে একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছিল জাতিসংঘের বৈশ্বিক খাদ্য কর্মসূচিও (ডব্লিউএফপি)। কিন্তু এর পরও সরবরাহ ও বাণিজ্য ব্যবস্থায় ব্যাঘাতের কারণে খাদ্যশস্যের গোটা বৈশ্বিক বাজারেই বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার জোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে গেছে। মহামারী ও লকডাউনের কারণে বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদনেও এখন মারাত্মক শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর কৃষি খামারে উৎপাদন কার্যক্রম এখন একরকম বন্ধ। একই পরিস্থিতিতে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। বাংলাদেশ-ভারতসহ এশিয়ার কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোও এখন এ সংকটে ভুগছে।

এ বিষয়ে এফএওর প্রধান অর্থনীতিবিদ ম্যাক্সিমো কুলেন এক পেপারে সতর্ক করে বলেন, মহামারী দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে কৃষক, কৃষিতে ব্যবহার্য কাঁচামাল ও অন্যান্য উপকরণ, প্রক্রিয়াকারী কারখানা, পরিবহন, রিটেইলার অন্যদের নিয়ে গড়ে ওঠা খাদ্যের জটিল সরবরাহ চেইন মারাত্মক চাপে পড়তে যাচ্ছে।

মহামারী ও এর ধারাবাহিকতায় সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি এখন নীতিনির্ধারকদের জন্য অনেক বড় এক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা এরই মধ্যে পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে। মহামারীর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব, বাণিজ্য ব্যবস্থার ধস ও লকডাউনের কারণে বৈশ্বিক কৃষিপণ্য ও খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা ভুগছে শ্রমিক, কাঁচামাল ও উপকরণ সংকটে। উপরন্তু বিভিন্ন দেশে ভোক্তাদের আতঙ্কজনিত অস্বাভাবিক ক্রয়প্রবণতার কারণেও খাদ্যনিরাপত্তার সংকটের আশঙ্কা আরো জোরালো হয়ে উঠেছে।

এতদিন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে খাদ্য চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি খাদ্যতালিকায় বৈচিত্র্য আনা সম্ভব হয়েছে আন্তর্জাতিক কৃষিপণ্য বাণিজ্য ব্যবস্থার সুবাদে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য বলছে, ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী খাদ্য বাণিজ্য মূল্যের হিসাবে বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। অর্থাৎ এ সময়ে বিভিন্ন দেশের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় বাণিজ্যনির্ভরতা বেড়েছে অনেক বেশি।

কিন্তু বর্তমানে এ ব্যবস্থাকেই পুরোপুরি ধসিয়ে দিয়েছে চলমান কভিড-১৯ মহামারী। উৎপাদন শ্লথ হয়ে পড়েছে মারাত্মক পর্যায়ে। বিশ্বজুড়েই কোটি কোটি কৃষি শ্রমিক এখন মাঠে কাজ করতে পারছেন না। বন্ধ রয়েছে ফসল রোপণ ও উত্তোলন প্রক্রিয়া।

বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে পণ্য পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে চালু রাখাও। সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি লকডাউনে সমুদ্রবন্দরগুলোয় কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ার কারণে সরবরাহ চ্যানেলগুলোও এখন পুরোপুরি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে উৎপাদনস্থল থেকে বাজারে কৃষিপণ্য স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও পরিবহন ব্যবস্থা শ্লথ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক উড়োজাহাজ গ্রাউন্ডেড থাকায় আকাশপথেও কমে গেছে সদ্য উৎপাদিত কৃষিপণ্যের পরিবহন। এবং একই সঙ্গে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় কন্টেইনারের সংকট।

অন্যদিকে ফিলিপাইন, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস ও আফ্রিকার বন্দরগুলোয় এ মুহূর্তে লকডাউনের কারণে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে বন্দরে খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্যের কন্টেইনারের স্তূপ জমলেও তা খালাস করার মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে দেশগুলোর স্থানীয় বাজারে খাদ্যমূল্য এখন বাড়তির দিকে।

বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার চলমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে ভোক্তাদের আতঙ্কজনিত অস্বাভাবিক ক্রয়প্রবণতা (প্যানিক বায়িং)। কভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই দেশে দেশে ভোক্তাদের মধ্যে এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বাজারে হুড়মুড় করে পণ্য কিনতে গিয়ে সুপারমার্কেট ও বাজারের সব তাক খালি করে ফেলছেন ক্রেতারা। অস্বাভাবিক ক্রেতা চাপ ও চাহিদার কারণে বাজারে সরবরাহ সংকট বাড়ছে। বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম।

সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় কৃষিপণ্য উৎপাদনকারীরাও এখন বেশ বিপাকে। পশ্চিম ভারতের উর্বর জেলা সাতারার কৃষকরা তাদের গবাদি পশুকে বর্তমানে আইসবার্গ লেটুস বা স্ট্রবেরির মতো দামি খাদ্যপণ্য খাওয়াচ্ছেন। পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় পচনশীল এসব পণ্য সংরক্ষণ করতে না পেরে পশুখাদ্য হিসেবেই কাজে লাগাচ্ছেন তারা।

তুরস্কভিত্তিক সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডে গতকাল প্রকাশিত এক নিবন্ধে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, কভিড-১৯-এর মতো ক্ষুধার কারণেও উন্নয়নশীল বিশ্বে এবার বহু মানুষ মারা যেতে পারে। বন্ধ হয়ে পড়তে পারে অনেক কৃষি খামার। একই সঙ্গে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয়ও দেখা দিতে যাচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তার সংকট। উন্নয়নশীল বিশ্বের যেসব দেশ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় খাদ্য রফতানি করত, সেসব দেশের পক্ষে এখন বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে উৎপাদিত খাদ্য বিক্রি করার বিলাসিতার সুযোগ নেই এখন। এসব দেশ এখন নিজের জ্বালাতেই জ্বলছে।