ব্যাংক হিসাবেই নগদ সহায়তা পেতে পারে ২ কোটি শ্রমজীবী
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০৪-১২ ০৮:০৫:৪২
চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) আঘাতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে দেশের দুই কোটির বেশি শ্রমজীবী মানুষ। লকডাউনের কারণে মাঠে পড়ে আছে ফসল, বড় ক্ষতির মুখে কৃষক। এ মুহূর্তে তাদের নেই কোনো আয়, নেই সঞ্চয়ও। অনাহার-অর্ধাহারে কাটছে দিন। অভাবগ্রস্ত এসব মানুষকে খাদ্যসহায়তা ও ১০ টাকা কেজি দরে চাল দিচ্ছে সরকার, যদিও বিতরণ পর্যায়ে নানা অনিয়মের কারণে সবার কাছে পৌঁছে না তা। এ অবস্থায় সরকার চাইলে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমেই দুই কোটি প্রান্তিক মানুষের কাছে নগদ সহায়তা পৌঁছে দিতে পারে।
কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এরই মধ্যে ভারতে কৃষকপ্রতি ২ হাজার রুপি দিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার, যা সরাসরি পৌঁছে গেছে কৃষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। প্রধানমন্ত্রীর কিষান স্কিমের আওতায় তিন ধাপের প্রথম ধাপে গত শুক্রবার এ অর্থ পেয়েছেন দেশটির প্রায় ৮ কোটি ৯২ লাখ কৃৃষক। পরবর্তী দুই ধাপে আরো ৪ হাজার রুপি করে পাবেন এসব কৃষক।
পাকিস্তানেও দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের দরিদ্র পরিবারগুলোকে ১২ হাজার রুপি করে নগদ সহায়তা দিচ্ছে দেশটির সরকার। এজন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৮৬৩ মিলিয়ন ডলারের তহবিল। এরই মধ্যে হাবিব ব্যাংক লিমিটেড ও ব্যাংক আল-ফালাহর প্রায় ১৭ হাজার শাখার মাধ্যমে প্রথম দফায় এ নগদ অর্থ প্রদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে তালিকাভুক্ত সবাইকে এ অর্থ দেবে দেশটির সরকার।
ভঙ্গুর অবস্থায় পড়ে যাওয়া জনগোষ্ঠীকে নগদ অর্থসহায়তা প্রদানে প্রতিবেশী এ দুটি দেশে ব্যাংক হিসাবকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হলেও বাংলাদেশে এখনো এমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যদিও গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য দেয়া প্রণোদনার অর্থ ব্যাংকের মাধ্যমে প্রদানের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের নানা শ্রেণীর পিছিয়ে পড়া মানুষেরও এখন আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় ব্যাংক হিসাব রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৫ লাখ ২০ হাজার ১৩৪। করোনা পরিস্থিতিতে এসব হিসাব হতে পারে নগদ সহায়তা প্রেরণের উত্কৃষ্ট মাধ্যম, যা ব্যবহার করে সহজেই নগদ সহায়তা প্রান্তিক মানুষের কাছে সরাসরি পৌঁছে দেয়া সম্ভব।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ এ বিষয়ে বলেন, এ ধরনের জাতীয় দুর্যোগে কারা সহায়তা পেতে পারে, সেসব টার্গেট গ্রুপ আমাদের পরিচিত। কয়েক বছর ধরেই ব্যাংকিং মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি কিংবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে আমরা একটি সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছি। কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতে পারে, কিন্তু এ তথ্যভাণ্ডার দিয়েই নগদ সহায়তা কার্যক্রম শুরু করতে পারি। প্রয়োজন অনুসারে সেটিকে বাড়ানো কিংবা আধুনিকায়ন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাতে পারি। কিন্তু খুব দ্রুতই এসব মানুষের নগদ ও খাদ্যসহায়তা পৌঁছানো দরকার।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, কৃষকের ব্যাংক হিসাব রয়েছে ১ কোটি ১ লাখ ৮৬ হাজার ৬০৫টি। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৫৬ লাখ ৭০৮, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতায় ২৬ লাখ ৬২ হাজার ১৬২, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ২ লাখ ৪৭ হাজার ৪৯৭ ও অন্যান্য সুবিধাভোগীর জন্য ১৮ লাখ ২৩ হাজার ১৬২টি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে। ওই সময় মোট ২ কোটি ৫ লাখ ২০ হাজার ১৩৪টি ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা।
বিশেষ হিসাবগুলোর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই কৃষকদের হিসাব। কৃষি কর্মকাণ্ডে সরকারি সহায়তার অংশ হিসেবে সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন ভর্তুকি প্রদানসহ অন্যান্য ব্যাংকিং সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে কৃষকদের হিসাব খোলা হয়। সরকারি ভর্তুকিপ্রাপ্ত এমন হিসাব সংখ্যা ২১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫৮। এছাড়া ৪৭ হাজার ৯৭২টি হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ ঋণ সুবিধা পেয়েছে। ফলে প্রায় ২২ লাখ কৃষক কিছু সুবিধা পেলেও সুবিধা পাননি প্রায় ৭৯ লাখ কৃষক। কিন্তু কৃষকের এখন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের শ্রমিক খরচ মেটাতে প্রয়োজন বিশেষ অর্থের। খেটে খাওয়া কৃষি শ্রমিকদের প্রয়োজন অর্থসহায়তা। পাশাপাশি কৃষকদের কৃষিপণ্য বিপণন কিংবা যন্ত্র কেনার জন্যও ভর্তুকি সহায়তা প্রয়োজন।
শুধু প্রণোদনা নয়, কৃষকের সার্বিক কার্যক্রমে সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংক হিসাব বেশ সহায়ক হতে পারে বলে মনে করছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা পুলের সদস্য মো. হামিদুর রহমান।
তিনি বলেন, এখন কৃষক পর্যায়ে প্রধান কাজ হবে ফসল উৎপাদনে কৃষকের মনোবল সুদৃঢ় করে তোলা। এজন্য তাদের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও অর্থপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। ভর্তুকি মূল্যে প্রদত্ত ধান কাটা যন্ত্র কৃষক পর্যায়ে পৌঁছাতে এবং কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তাদের কম সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে ব্যাংক হিসাবগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। পাশাপাশি উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত নিশ্চিত করতে, বিশেষ করে চলতি বোরো মৌসুম থেকে সরকারের পক্ষ থেকে ন্যায্যমূল্যে প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহের কার্যক্রম বাড়াতে হবে। সেটি স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হলে এসব ব্যাংক হিসাব খুবই কার্যকর হতে পারে।
জানা গেছে, তফসিলি ব্যাংকে হিসাব খোলার মাধ্যমে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও আর্থিক সেবা-বহির্ভূত সব জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনার বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব হিসাবে ন্যূনতম স্থিতি রাখার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই এবং ব্যাংক কর্তৃক কোনো চার্জ বা ফি আরোপ করা হয় না। তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব হিসাবে গড়ে ১ হাজার ১৪৮ টাকা করে জমা ছিল। এসব ব্যাংক হিসাবের মধ্যে কিছু হিসাবধারী সরকারের নিয়মিত সহায়তা কার্যক্রমের মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। ফলে সেটি ব্যবহারে আমাদের দক্ষতা আরো বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখতে হবে কোন শ্রেণীর মানুষ বিপদে রয়েছে। তাদের কাছে কত দ্রুত সরকারের প্রয়োজনীয় সেবা, বিশেষ করে নগদ অর্থ ও খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানো যেতে পারে, সেটাই বিবেচনায় নিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্যসহায়তা ও ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু সেটি যেমন চাহিদার তুলনায় কম, তেমনি বিতরণে দুর্নীতির অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে হবে। আবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী সম্প্রসারণ করতে হবে। কৃষক, কৃষি শ্রমিকের আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার পাশাপাশি প্রান্তিক ও অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমে যে বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে, সেখানে দ্রুত অর্থ প্রেরণ করতে হবে। ব্যাংক হিসাবের পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আওতায় নগদ অর্থ পাঠানো গেলে অস্বচ্ছতা অনেকটাই কমবে এবং দ্রুততার সঙ্গে এসব সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে। সূত্র:বণিক বার্তা