সিঙ্গাপুরে করোনা আক্রান্ত বাংলাদেশির সংখ্যা ২৬০০ ছাড়িয়েছে
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০৪-১৯ ১৬:৪৩:২৩
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করার ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরকে একটি সফল উদাহরণ হিসেবেই এতদিন মনে করা হচ্ছিল। করোনাভাইরাস শব্দটি যখন অনেকের কাছেই পরিচিত হয়ে ওঠেনি, তখনই সিঙ্গাপুরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে এবং আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে।
এর মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করেছিল দেশটি। কিন্তু সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেশ দ্রুত গতিতে বিস্তার লাভ করছে।
দেশটিতে এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ৫৮৮ জন৷ এর মধ্যে বাংলাদেশি রয়েছে ২ হাজার ৬০০ জন। সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছে ৭৪০ জন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন এ পর্যন্ত ১১ জন।
সিঙ্গাপুরে করোনার সবচেয়ে বড় ক্লাস্টার হিসেবে পংগল এস-১১ ডরমিটরিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে মোট ১৩টি ডরমিটরিকে আইসোলেশন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে৷ এসব ডরমিটরিতে বাংলাদেশের নাগরিকই বেশি থাকে।
সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে। শনিবার নতুন করে ৯৪২ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৭০ জনই বাংলাদেশি।
শুক্রবার দেশটিতে নতুন রোগী শনাক্ত হয় ৭২৮ জন। এর মধ্যে ৫২০ জন বাংলাদেশি।
এছাড়া বৃহস্পতিবার ৪৪৭ জন করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে ৩৪৪ জনই বাংলাদেশি। বুধবার ৩৩৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে ১৭১ জনই বাংলাদেশি।
এর আগে, মঙ্গলবার ৩৮৬ জন করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে ২০৯ জনই বাংলাদেশি। সোমবার ২৩৩ জন করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে ১২৫ জনই বাংলাদেশি। রোববার ১৯১ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯৯ জনই বাংলাদেশি।
সিঙ্গাপুরে যেদিন প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়৷ সেদিনই দেশটির সরকার নড়েচড়ে বসে৷ তারা করোনা মোকাবিলায় জাতীয় কমিটি গঠন করে। তিনটি রিস্ক লেভেল ঘোষণা করা হয়৷ রিস্ক লেভেলগুলো হলো; ইয়োলা, অরেঞ্জ ও রেড৷ ইয়োলো মানে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবাই সর্বশেষ চীন ভ্রমণ করেছেন। অল্পসংখ্যক লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত৷
দ্বিতীয় রিস্ক লেভেল অরেঞ্জ মানে কিছু কিছু স্থানীয় লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত যাদের কেউ চীন ভ্রমণ করেনি কিংবা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগীর সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই৷
সর্বশেষ রিস্ক লেভেল রেড (লাল) অর্থাৎ সারাদেশে বিভিন্ন স্থান থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলে এবং প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেই রিস্ক লেভেল রেড (লাল) ঘোষণা করা হবে৷ এখন চলছে রিস্ক লেভেল অরেঞ্জ৷
১) সদ্য চীনফেরত ব্যক্তিদের ১৪ দিনের লিভ অফ এবসেন্সে পাঠানো হয়। এই ১৪ দিন তারা বাসায় থাকবে। তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করা হবে। যদি এ সময়ের মধ্যে শরীরে করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা না যায় তবেই কাজে যেতে পারবে৷
২) প্রতিটি বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি এমনকি শপিং মলের সিঁড়ি, লিফট ক্যামিকেল স্প্রে করে ভাইরাস মুক্ত করা হয়৷ ৩) স্থানীয় ও অভিবাসী প্রত্যেকের দৈনিক ২ বার শরীরের তাপমাত্রা চেক করা হয়৷
৪) কোনো এক গ্রুপের একজন বা কোন বাসার একজনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সে পরিবার বা গ্রুপের সকলকে আলাদাভাবে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়৷ যাতে করোনাভাইরাস ছড়াতে না পারে৷
৫) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সরকারি খরচে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে৷ ৬) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি সর্বশেষ গির্জায় ভ্রমণ করার কারণে তিনটি গির্জা বন্ধ করে দেওয়া হয়৷
৭) এমপি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি একমাসের বেতন করোনা মোকাবিলার জন্য সরকারি তহবিলে অনুদান দেয়। ৮) সিঙ্গাপুর জনশক্তি মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ভাষায় (বাংলা, তামিল, ইংরেজি ও অন্যান্য) সচেতনতামূলক বিভিন্ন লিফলেট বিতরণ করা শুরু করে৷
৯) গৃহকর্মীরা সিঙ্গাপুরে ফিরলে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকা বাধ্যতামূলক করে। ১০) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কয়েকজন কয়েকটি মসজিদে নামাজ আদায় করতে যাওয়ার কারণে সিঙ্গাপুরের সমস্ত মসজিদ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ১১) যেকোন দেশ থেকে সিঙ্গাপুরে এলে তাকে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে৷ এই নিয়ম সিঙ্গাপুরে বসবাসকারী স্থানীয় ও অভিবাসী সকলের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য করা হয়।
১২) গৃহকর্মী যারা ছুটিতে আছে তাদের সিঙ্গাপুরে ফিরতে হলে জনশক্তি মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিতে হবে৷ বর্তমান অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত তাদের ছুটিতে দেশে যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
১৩) সমস্ত ওয়ার্ক পাশ হোল্ডার, এমনকি ডিপেনডেন্ট পাশ হোল্ডাদের সিঙ্গাপুরে প্রবেশ করতে হলে দেশটির জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। সিঙ্গাপুরে প্রবেশের পর বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে৷
১৪) ভ্রমণের ক্ষেত্রে কয়েকটি দেশে কড়াকড়ি নির্দেশনা জারি করে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, জাপান, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং আসিয়ান দেশসমূহ থেকে সিঙ্গাপুরে ফিরলে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকা বাধ্যতামূলক করে৷
১৫) তাছাড়া চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া ও স্পেন এই ৭টি দেশ থেকে সিঙ্গাপুরে ভ্রমণ কিংবা ট্রানজিট করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়৷ ১৬) সিঙ্গাপুরে ফিরলে যেকোন দেশের নাগরিককে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়।
১৭) সিঙ্গাপুরে প্রবেশ করতে হলে সমস্ত ওয়ার্ক পাস হোল্ডার, এমনকি ডিপেনডেন্ট পাশ হোল্ডাদের সিঙ্গাপুরের জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে এবং সিঙ্গাপুরে প্রবেশের পর বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে৷
১৮) ট্যাক টুগেদার নামে মোবাইল অ্যাপ চালু করা হয়৷ এর মাধ্যমে খুব সহজেই কন্ট্রাক ট্রাক করা যাবে৷ অর্থাৎ ব্যবহারকারী কোনো করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে গেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তার সাথে যোগাযোগ করে পরিবর্তী করণীয় জানানো হবে৷
১৯) কোনো ওয়ার্ক পাশ হোল্ডার যদি দেশে যায় তবে তার নিজ দায়িত্বে যেতে হবে। এই পরিস্থিতিতে কোন ওয়ার্ক পাশ হোল্ডার দেশে গেলে পরিবর্তীতে তারা আর সিঙ্গাপুরে ফিরতে পারবে না৷
২০) সিঙ্গাপুরে যেকোন দেশের ভিজিটর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়৷ ২১) সিঙ্গাপুরের সমস্ত বিনোদন কেন্দ্র, বার, অডিটোরিয়াম বন্ধ ঘোষণা করা হয়৷ ২২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস এমনকি খাবার টেবিলে একসাথে দশজনের বেশি বসা যাবে না।
২৩) অফিস, রাস্তাঘাট, জায়গায় একজন থেকে আরেকজন এক মিটার দূরত্বে থাকতে হবে৷ এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে ১০ হাজার ডলার বা ৬ মাসের জেল অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।
এর আগে, সর্তকতা অবলম্বনের জন্য সিঙ্গাপুর সরকার ৭টি দেশকে নিষিদ্ধ করেছে। এই সাত দেশ থেকে সিঙ্গাপুর ভ্রমণে আসা যাবে না এমনকি সিঙ্গাপুরকে ট্রানজিট হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে না। দেশগুলো হলো: চীস, ফ্রান্স,জার্মানি, ইতালি, ইরান, দক্ষিন কোরিয়া ও স্পেন।
বাংলাদেশি শ্রমিকরা কেন বেশি আক্রান্ত?
দীর্ঘদিন যাবত সিঙ্গাপুরে বসবাস করেন বাংলাদেশি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল মান্নান। সেখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটির সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখেন মান্নান। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশিদের মাঝে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার বেশি হওয়ার একটি কারণ অল্প জায়গায় অনেক বেশি শ্রমিকের বসবাস।
দেশটিতে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা সবসময় দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করতে পছন্দ করেন, ফলে তাদের মধ্যে বেশ দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ‘বাঙালি শ্রমিকদের সমস্যা হচ্ছে, প্রতি রোববার তারা এক জায়গায় জড়ো হয়। মোস্তফা মার্টের সামনে একটা মাঠ আছে। সেখানে তারা দলবদ্ধভাবে বসে আড্ডা দেয়, খাবার খায়। ইন্ডিয়ান বা চায়নিজরা এটা করে না’।
এছাড়া শুরু থেকেই করোনাভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে তেমন কোন সচেতনতা ছিল না বলে জানান এই সিঙ্গাপুর প্রবাসী।
এসব দেশ থেকে ভ্রমণ শেষে নাগরিকরা সিঙ্গাপুরে ফিরলে তাদের বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। দেশগুলো হলো, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, ইতালি, ফ্রান্স,জার্মানি, স্পেন, জাপান, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং আসিয়ান দেশ (ব্রুনাই, লাওস, মায়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন,থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর)।
আরও কয়েকটি দেশ থেকে সিঙ্গাপুরে ভ্রমণ কিংবা চাকরির সুবাদে আসা যাবে তবে তাকে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন থাকতে হবে। দেশগুলো হলো : জাপান, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং আসিয়ানভুক্ত দেশ। তবে মালয়শিয়া এই নিয়মের আওতায় থাকবে না।
তবে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো থেকে আসার আগে করোনাভাইরাস মুক্ত স্বাস্থ্য সনদ সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে বলে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কোন নির্দেশনা জারি করা হয়নি। তাই বাংলাদেশিদের সিঙ্গাপুরে আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোন প্রভাব পড়বে না।
তবে বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে আসার পর বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে। যদি করোনাভাইরাসে কোন লক্ষণ ধরা পড়ে তবে তাকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হবে। আর সুস্থ থাকলে সরাসরি নিজ নিজ বাসস্থানে আসতে পারবে।
সিঙ্গাপুরে বসবাসকারী স্থানীয় ও অভিবাসীদের করোনাভাইরাসের চিকিৎসা সিঙ্গাপুর সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে করা হচ্ছে। তবে ভ্রমণকারী বা পর্যটকদের চিকিৎসা ব্যয় সিঙ্গাপুর সরকার বহন করবে না।
বিশ্বে নতুন এই ভাইরাসের তাণ্ডব মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশে ব্যাপক বিধি-নিষেধ আরোপ করা হলেও প্রাণহানি ও সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। বেশ কয়েকটি দেশ প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের প্রতিষেধক এবং ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে চীন, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি ওষুধেরও পরীক্ষা চালানো হয়েছে। তবে প্রতিষেধক কিংবা ওষুধের জন্য আরও দেড় বছরের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে।
সানবিডি/ঢাকা/এসএস