করোনায় পুরোনো নোট তুলে নেয়ার প্রস্তুতি
৩০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট আসছে বাজারে
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০৪-২৯ ০৮:২৬:০০
সাধারণত পবিত্র ঈদের মতো বড় উৎসবকে কেন্দ্র করে সবসময়ই বাজারে নতুন নোট ছাড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এবারের পরিস্থিতি একেবারেই ব্যতিক্রম। মারণঘাতি করোনাভাইরাসের আগ্রাসনে বিপর্যস্ত হয়েছে জনজীবন। একই সঙ্গে বিধ্বস্ত হয়েছে অর্থনীতি। পহেলা বৈশাখের মতোই বর্ণহীন থাকবে এবারের ঈদুল ফিতরের উৎসবও। তার পরও বাজারে ৩০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ রুখতে ৬০ হাজার কোটি ইউয়ান মূল্যমানের কাগুজে নোট পুড়িয়ে ফেলেছিল চীন। পৃথিবীর অনেক দেশই চীনের পথ অনুসরণ করেছে। বাজারে নতুন নোট ছেড়ে ব্যবহূত নোট তুলে নিচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। এবার বাংলাদেশ ব্যাংকও এ তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ২৫ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছেড়ে বাজার থেকে পুরনো টাকা তুলে নেয়া হবে। এর পরও নগদ টাকার প্রয়োজন হলে আরো ৫ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাড়ার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।
ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য থেকে নোট ছাপানোর কাগজ-কালিসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। করোনাভাইরাসের প্রভাবে ইউরোপের এসব দেশও বহু আগে লকডাউনে চলে যায়। পণ্য দেশে আনার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে পাওয়া যায়নি জাহাজও। দেশেও সাধারণ ছুটি চলছে ২৬ মার্চ থেকে। ফলে নোট ছাপানোর উপকরণ আমদানি ও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড়াতে গিয়ে এবার বেশ বিড়ম্বনাই পোহাতে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।
তবে শেষ পর্যন্ত কাগুজে নোট ছাপানোর উপকরণ সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনে পৌঁছেছে। সরকারি ছুটি ঘোষণার পর বন্ধ হয়ে যাওয়া মেশিনগুলো আবারো সচল করা হয়েছে। ছুটিতে যাওয়া কর্মীরাও যোগ দিয়েছেন টাকা ছাপানোর কাজে। এতে কর্মমুখর হয়ে উঠেছে টাঁকশাল।
দেশে টাকা ছাপানো ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ। বিভাগটির তথ্যমতে, আগে থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে এক হাজার টাকার বিপুল পরিমান নোট মজুদ ছিল। ফলে নতুন করে এক হাজার টাকার নোট ছাপানো হচ্ছে না। এবার সবচেয়ে বেশি ছাপানো হবে ৫০০, ২০০, ১০০, ৫০, ২০ ও ১০ টাকার নোট। এর মধ্যে ৫০০ টাকার নোট ছাপানো হচ্ছে ৩৭ কোটি। এ হিসাবে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা মূল্যমানের ৫০০ টাকার নোট ছাপানো হবে। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে চালু করা ২০০ টাকার নোট ছাপানো হচ্ছে ২০ কোটি। এছাড়া ৩৫ কোটি নোট ছাপানো হচ্ছে ১০০ টাকার। তবে সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ছাপানো হচ্ছে ৫০, ২০ ও ১০ টাকার নোট।
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যাওয়ায় এ মুহূর্তে দেশে ছোট নোটের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। বেশি মানুষের হাতবদল হওয়ায় ছোট নোট দ্রুততম সময়ে নষ্টও হয়ে যায়। তাছাড়া করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে বাজার থেকে ব্যবহূত ছোট নোটগুলো তুলে নেয়া দরকার। সবদিক বিবেচনা করেই নতুন নোট ছাপানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যদিও এবারের ঈদুল ফিতরে নতুন টাকার চাহিদা কম থাকবে।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংক এশিয়ার শীর্ষ নির্বাহী মো. আরফান আলী বলেন, করোনাভাইরাস কাগুজে নোটের মাধ্যমে গণহারে ছড়ানোর বিষয়টি প্রমাণিত নয়। তার পরও সতর্কতা হিসেবে বিশ্বের অনেক দেশই বাজার থেকে পুরনো নোট তুলে নিয়ে নতুন নোট ছাড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগও প্রশংসনীয়।
তিনি বলেন, মানুষ ব্যাংক থেকে ব্যাপক মাত্রায় নগদ টাকা তুলছে। বিপরীতে জমা দিচ্ছে কম। স্বাভাবিক সময়ে ব্যাংক এশিয়ায় দৈনিক ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। বর্তমানে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এ পরিস্থিতি দেশের সব ব্যাংকেরই। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা মূল্যের কাগুজে নোট প্রচলিত রয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে কাগুজে নোটের চাহিদা ১ লাখ ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ থাকে। তবে করোনাভাইরাসে সৃষ্ট দুর্যোগে ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই নগদ টাকা তুলতে ব্যাংকে বাড়তে থাকে গ্রাহকদের ভিড়। মার্চ থেকে গ্রাহকদের এ ভিড় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। বিপরীতে ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার প্রবণতা কমেছে প্রায় ৯০ শতাংশ। ব্যাংকগুলোকে চাহিদা অনুযায়ী নগদ টাকা সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে নেয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে। বিভাগটিতে ব্যাংকের গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী নগদ টাকা সরবরাহ করতে ঢাকা থেকেও নোটের জোগান দিতে হয়। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়ার প্রবণতার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে ছিল ঢাকা। এ অবস্থায় বাজারে কাগুজে নোটের পরিমাণ বাড়ানোরও চিন্তা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন নোট প্রস্তুত হলে দেশে কাগুজে নোটের পরিমাণ ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হতে পারে।
করোনাভাইরাসে সৃষ্ট বিপর্যয় থেকে উত্তরণে কৃষক, ছোট-বড় শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। স্বল্প সুদে ঋণ হিসেবে এসব প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৩৮ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। সে হিসাবে অর্থনীতিতে এই ৩৮ হাজার কোটি টাকা নতুন করে যুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ডিমান্ড-সাপ্লাই নীতি অনুসরণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সারা বছরই বাজারে নোট সরবরাহ করে। প্রতি ঈদের আগেই বাজারে নতুন টাকা ছাড়া হয়। তবে এবারের ঈদের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা তহবিলের ঘোষণা দিচ্ছে। এজন্য করোনাভাইরাসে সৃষ্ট দুর্যোগের সবদিক পর্যালোচনা করেই বাজারে নতুন নোট ছাড়া হবে।
তিনি বলেন, গত ঈদেও বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছেড়েছিল। এবার এর পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।