মহামারি করোনা

মালয়েশিয়ায় ব্যবসা ও চাকরি হারাচ্ছে প্রবাসীরা

সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২০-০৫-১৫ ০৯:২৬:৩৩


বর্তমান সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় শ্রমবাজার হচ্ছে মালয়েশিয়া। দেশটিতে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ বাংলাদেশী কর্মরত আছেন, যাদের বড় অংশই শ্রমিক। অনেকেই আবার ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত। চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দেশটিতে চাকরি ও ব্যবসা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন এসব বাংলাদেশী।

১০ বছর আগে মালয়েশিয়া যান বরগুনার হামিদ আলী। প্রথমে একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও পরবর্তী সময়ে শুরু করেন ব্যবসা। তবে বৈধ উপায়ে মালয়েশিয়ায় বিদেশীদের ব্যবসা করা জটিল হওয়ায় বিয়ে করেন এক মালয় নারীকে। বর্তমানে স্ত্রীর নামে করা লাইসেন্সে একটি খাবারের হোটেল চালাচ্ছেন হামিদ। আরো পাঁচজন বাংলাদেশী কাজ করছেন তার এ প্রতিষ্ঠানে। হামিদের মতো আরো কয়েক হাজার বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় খাবারের হোটেল, মুদি দোকানসহ নানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছেন, যাদের অধিকাংশই কোনো মালয়েশীয় নাগরিকের লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন। করোনা পরিস্থিতিতে হঠা? করেই সংকটে পড়েছেন এসব প্রবাসী বাংলাদেশী। মালয়েশিয়া সরকারের কঠোর সিদ্ধান্তে এরই মধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অনেক বাংলাদেশীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আর এ সময় গ্রেফতার হয়ে যারা কারাগারে আছেন, তারা দেশটির সরকারের কালো তালিকায় ঢুকে পড়ার আশঙ্কাই বেশি।

চলমান করোনা পরিস্থিতিতেও মালয়েশিয়ায় অবৈধ প্রবাসীদের আটক অভিযান চলছে। প্রতিদিনই গ্রেফতার হচ্ছেন অবৈধ অভিবাসীরা। এরই মধ্যে বাংলাদেশীসহ বিভিন্ন দেশের দেড় হাজারের বেশি প্রবাসীকে আটক করেছে দেশটির অভিবাসন বিভাগ।

করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ লকডাউন শেষে ৪ মে থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মুদি দোকান খোলার অনুমতি দেয় মালয়েশিয়া সরকার। এর পর থেকেই শুরু হয় বিদেশীদের দ্বারা পরিচালিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অভিযান। আর এতেই বিপাকে পড়েন অন্যের লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে ছোটখাটো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসা কয়েক হাজার প্রবাসী বাংলাদেশী।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মালয়েশিয়া প্রবাসী একজন বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী  বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ সময় রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখতে হয়েছে। এতে মারাত্মক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে লকডাউন কিছুটা শিথিল করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে একই সময় থেকে অভিযান শুরু হয়েছে বিদেশীদের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে, যা করোনার এই দুর্যোগকালে কোনোভাবেই কাম্য ছিল না। আকস্মিক এ অভিযানে প্রবাসী ছোট ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ইমিগ্রেশন রেগুলেশন ১৯৬৩-এর ৩৯ (বি) অনুচ্ছেদ অনুসারে ৭ মে থেকে রাজধানী কুয়ালালামপুরে কয়েকটি স্থানে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন বিদেশী ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়েছে। তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। আর যারা ভিসার অবৈধ ব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন।

জানা গেছে, ১১ মে অভিযান চালানো হয় মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার সেলায়েং পাসার ও এর আশপাশের এলাকার বিদেশীদের দ্বারা পরিচালিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। এ অভিযানে ৭ হাজার ৫৫১ জন অভিবাসীর কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে ১ হাজার ৩৬৮ জনকে আটক করা হয়, যার মধ্যে ৭৮ জন ছিলেন বাংলাদেশী। আটককৃতদের মধ্যে বেশি ছিলেন মিয়ানমারের নাগরিক, তাদের সংখ্যা ৭৯০। এছাড়া ভারত, পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিকও রয়েছেন।

এর আগে ৯ মে অভিযান চালানো হয় কুয়ালালামপুরের বুকিত বিনতাংয়ে। সেখানে বেশ কয়েকটি বাংলাদেশী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেয়া হয়। এরও আগে লকডাউন চলাকালে কুয়ালালামপুরে সিটি ওয়ান প্লাজায় অভিযান চালিয়ে তিন শতাধিক অবৈধ অভিবাসীকে আটক করে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ।

৮ মে মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের প্রধান দাতুক খায়রুল দাজায়মি দাউদ স্থানীয় গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাকারে বলেন, কুয়ালালামপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় বিদেশী অভিবাসীরা ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে বসে পরিচালনা করছে, যা অভিবাসন আইনে অবৈধ। আমরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করব।

প্রবাসীদের অভিযোগ, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সবকিছু বন্ধ থাকায় এমনিতেই দুর্দশা চলছে। সবচেয়ে সংকটে পড়েছেন অবৈধরা। কারণ বেশির ভাগ অবৈধ শ্রমিক বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, মার্কেটে কাজ করতেন। এসব বন্ধ থাকায় তাদের বেতনও বন্ধ। এরই মধ্যে চলছে ধরপাকড়। গ্রেফতার আতঙ্কে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস ও আর্থিক দুরবস্থায় কর্মহীন দিন কাটছে প্রবাসীদের। একদিকে মালয়েশিয়া সরকার ঘোষণা দিয়েছে বৈধ-অবৈধ সব প্রবাসীকে বাধ্যতামূলক কভিড-১৯ পরীক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে অবৈধদের গ্রেফতারে চালানো হচ্ছে অভিযান।

মালয়েশিয়ায় শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা মার্সি মালয়েশিয়ার সভাপতি দাতুক ডা. আহমদ ফয়জাল পারদৌস গত বুধবার গণমাধ্যমকে বলেন, অনিবন্ধিত প্রবাসী শ্রমিকরা সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে এগিয়ে আসার সম্ভাবনা কম। এর কারণ এটি নয় যে তারা পরীক্ষা করতে চান না, তারা আটক হওয়ার ভয়ে রয়েছেন।

উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্যের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় গেছেন প্রায় ১ লাখ কর্মী। ২০১৮ সালেও দেশটিতে গেছেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯২৭ জন কর্মী। ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশী কর্মী নেয়া বন্ধ হয়ে যায়। গত বছর দেশটিতে গেছেন মাত্র ৫৪৫ জন।