কৌশলে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০৫-১৮ ১২:৪০:২৬


করোনা জেঁকে বসায় গত ২৬ মার্চ থেকে চলছে সাধারণ ছুটি। বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন। ঈদ সামনে রেখে রাজধানী ঢাকায় ঢুকতে ও বের হতে কড়াকড়ি আরোপের কথা বলেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু নানা ফন্দিতে ঢাকা ছাড়ছে ‘কৌশলী’ মানুষ। বেশি টাকা খরচ হলেও ভেঙে ভেঙে রিকশা, অটোরিকশা, মহেন্দ্র, ট্রাক, পিকআপ ভ্যানসহ নানা যানবাহনে মানুষ ছুটছে। তবে যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের অনেকে ‘অসুস্থতা’র ছুতায় অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে ঢাকা ছাড়ছে।

ঝালকাঠির রাজাপুরের নারিকেলবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. মাসুম বিল্লাহ পলাশ। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাদে ঢাকার মিরপুর এলাকায় বাস করেন। গত শুক্রবার ঢাকা থেকে রাজাপুরে নিজ বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন তিনি। ঢাকা থেকে রাজাপুরের বাড়িতে আসতে ১৪ বার যানবাহন পাল্টেছেন তিনি। এ যাত্রায় তাঁর খরচ হয়েছে এক হাজার ৮২০ টাকা। সময় লেগেছে প্রায় ১৬ ঘণ্টা।

বাড়ি ফেরার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি জানান, ভোর ৫টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে রিকশায় মিরপুর-১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে আসেন ৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে। সেখান থেকে মিরপুর-১ নম্বর হয়ে সিএনজি অটোরিকশায় গাবতলী আসেন ১৮০ টাকায়। গাবতলী থেকে ৪০০ টাকা ভাড়ায় একটি মাইক্রোবাসে ওঠেন পাটুরিয়া ফেরিঘাটের উদ্দেশে। ফেরিতে কোনো টাকা দিতে হয়নি। পদ্মা পাড়ি দিয়ে দৌলতদিয়া এসে ১৮০ টাকায় ফরিদপুর সদরে আসেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায়। ফরিদপুর থেকে মহেন্দ্রতে ১৫০ টাকায় আসেন ভাঙ্গা পর্যন্ত। সেখান থেকে অটোরিকশায় ১৫০ টাকায় আসেন বরিশালের বুরঘাটা পর্যন্ত। বুরঘাটা থেকে ভ্যানগাড়িতে ৮০ টাকা দিয়ে অচেনা একটি স্থানে আসেন। সেখান থেকে ১০০ টাকা খরচায় আরেকটি ভ্যানগাড়িতে আসেন বরিশালের রহমতপুর বিমানবন্দর পর্যন্ত। রহমতপুর বিমানবন্দর থেকে ৭০ টাকায় বরিশালের নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ডে আসেন ভ্যানে। সেখান থেকে অটোরিকশায় রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডে আসেন ৩০ টাকায়। রূপাতলী থেকে কালিজিরা সেতু পর্যন্ত ৩০ টাকায় আসেন আরেকটি অটোরিকশায়। সেখান থেকে ১৫০ টাকা দিয়ে ঝালকাঠিতে আসেন একটি প্রাইভেট কারে। ঝালকাঠি থেকে ১০০ টাকায় অটোরিকশায় আসেন রাজাপুরে। রাজাপুর থেকে নিজ বাড়ি নারিকেলবাড়িয়ায় যান অটোরিকশায় ১৫০ টাকার বিনিময়ে। সব মিলিয়ে তাঁর মোট খরচ হয় এক হাজার ৮২০ টাকা।

তিনি আরো বলেন, গত বুধবার অফিস থেকে বাসায় আসার পথে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে। ফলে পরদিন শরীরে জ্বর আসে। জ্বর হওয়ায় কম্পানি ছুটি মঞ্জুর করে। ঢাকায় চিকিৎসা পাব কি না, সে চিন্তা করেই বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই। দেশে যখন স্বাভাবিক অবস্থা ছিল, তখন ঢাকা থেকে সরাসরি ৪৫০-৫০০ টাকায় রাজাপুর আসা যেত। সময় লাগত ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। সেখানে বর্তমানে প্রায় চার গুণ ভাড়া গুনতে হচ্ছে। পাশাপাশি সময় লাগছে তিন গুণ।

লকডাউন উপেক্ষা করে ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পণ্যবাহী ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনে ঢাকা থেকে কৌশলে ঠাকুরগাঁওয়ে ঢুকছে মানুষ। তবে মানুষজন দেখতে পেলে অনেক সময় ফিরিয়েও দিচ্ছে। গতকাল রবিবার দুপুরে সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কার্যালয়সংলগ্ন ঢাকা-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাকে ৩০ যাত্রী শহরে ঢোকার চেষ্টা করে। এ সময় স্থানীয় যুবকরা পিছু নিয়ে ট্রাকটি জব্দ করে। পরে ট্রাকের পেছনে ত্রিপলের ভেতর ও ট্রাকচালকের স্থান থেকে বেরিয়ে আসে ৩০ যাত্রী। যাত্রীরা সবাই ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।

স্থানীয় এক যুবক মোহাম্মদ জসিম জানান, ঠাকুরগাঁওয়ের প্রবেশদ্বার ২৯ মাইল নামক স্থান পার হয়ে বড়খোচাবাড়ী বাজারের আগে ওই ট্রাক থেকে দুজনকে নামতে দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। পরে ট্রাকটি ধাওয়া করে ৩০ যাত্রী পাওয়া যায়। জনরোষে পড়ার আগেই যাত্রীসহ ট্রাকটি তাত্ক্ষণিক ফেরত চলে যায়।

যাত্রীদের একজন ঠাকুরগাঁও হরিপুর উপজেলার বাসিন্দা সাজেদুল ইসলাম বলেন, ট্রাকের সব যাত্রীই ঢাকায় গার্মেন্ট ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। সামনে ঈদ ও দীর্ঘ ছুটির কারণে সবাই ঠাকুরগাঁওয়ে যাচ্ছিল। এ জন্য ট্রাকের চালক জনপ্রতি এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা করে নিয়েছেন।

সদর থানার ওসি তানভিরুল ইসলাম জানান, শহরের প্রবেশদ্বার ২৯ মাইল এলাকায় চেকপোস্ট বসানোর পরও অনেক সময় কৌশলে কোনো কোনো ট্রাক ও অ্যাম্বুল্যান্সে করে যাত্রী আনা-নেওয়া করা হচ্ছে। গত কয়েক দিনে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকার গুলশানের দোকান কর্মচারী শহিদুর ইসলাম। করোনা সংকটে দোকানটি বন্ধ। অর্ধেক বেতন দিয়ে মালিক বলেছেন দোকান খুললে যোগাযোগ করতে। বাধ্য হচ্ছেন গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী ফিরে যেতে। গতকাল রবিবার ভোর ৫টার দিকে ঢাকার গাবতলী থেকে রওনা দিয়েছেন। সকাল ১১টা নাগাদ তিনি পৌঁছাতে পেরেছেন মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ফেরিঘাট পর্যন্ত। ততক্ষণে তাঁর ভাড়া বাবদ খরচ হয়ে গেছে প্রায় ৫৪০ টাকা। অথচ বাড়ির পথ বাকি রয়েছে আরো অনেকটা। গতকাল রবিবার শহিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় পাটুরিয়া ৪ নম্বর ফেরিঘাটে। তিনি জানান, ঢাকার গাবতলী থেকে পাটুরিয়া ঘাটের দূরত্ব কমবেশি ৬০ কিলোমিটার। স্বাভাবিক সময় এ রাস্তাটুকু পার হতে সময় লাগে বড়জোর আড়াই ঘণ্টা। পরিবহন ভেদে ভাড়া ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। অথচ রাস্তায় কোনো যানজট না থাকলেও তাঁর সময় লেগেছে প্রায় ছয় ঘণ্টা। আর খরচা হয়েছে ৫০০ টাকার ওপর।

গত শনিবার ভোর ৫টায় রাজধানীর মিরপুর থেকে চাঁদপুরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন মো. খোকন, নূপুর আক্তার আর তাঁদের শিশুসন্তান সায়মুন। কখনো ব্যাটারিচালিত রিকশায়, কখনো অটোরিকশায় আবার কখনো হেঁটে বিকেল নাগাদ ফেরেন গ্রামের বাড়ি। তবে গ্রামে বাইরে থেকে মানুষ এসেছে, এমন সংবাদ পৌঁছে যায় স্বাস্থ্য বিভাগে। তাই করোনা পরিস্থিতিতে তাঁদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে সেখানে যান স্বাস্থ্যকর্মীরা।

মো. খোকন জানান, রাজধানীর মিরপুরের একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে চাকরি ছিল তাঁর। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি বিধি-নিষেধের কারণে বন্ধ হয়ে যায় তাঁর প্রতিষ্ঠান। তাই বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী নূপুর আক্তার জানান, স্বামীর আয়ের পথ বন্ধ হওয়ায় অনেক কষ্টেই তাঁদের জীবন কাটছিল। তাই বাড়িতে ফিরে আসেন।

শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌপথে ঘরমুখী যাত্রীদের ভিড় বাড়ছেই। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ঢাকা থেকে বিভিন্ন পরিবহনে শিমুলিয়া ঘাটে এসে ফেরিতে পদ্মা পাড়ি দিচ্ছে তারা। তবে গতকাল রবিবার শিমুলিয়া ঘাটে যেতে যাত্রীদের অনেক দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কয়েকটি চেকপোস্টে যাত্রীদের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অনেক যানবাহনকে ফিরিয়েও দিয়েছে পুলিশ। তার পরও গাদাগাদি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।
সূত্র: কালের কণ্ঠ
সানবিডি/ঢাকা/এসএস