মহামারি করোনা সংকট
দেশের রফতানির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন পণ্য
সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২০-০৫-১৯ ০৯:৩৩:৫৬
প্রাণঘাতি নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) কারণে সৃষ্ট মহামারি পরিস্থিতিতে পণ্যের বৈশ্বিক চাহিদা কমে আসায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল দেশের রফতানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের রফতানি। তবে এই করোনাভাইরাস পরিস্থিতি রফতানি খাতের জন্য কিছু সম্ভাবনাও নিয়ে এসেছে। রফতানি তালিকায় যুক্ত করেছে নতুন কিছু পণ্য, ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (পিপিই) হিসেবে যার চাহিদা বেড়েছে পুরো বিশ্বে।
এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মানুষের জীবনযাপনের ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। বেড়েছে মাস্ক বা মুখোশের ব্যবহার। মাস্ক ছাড়াও যে পণ্যগুলোর ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে আছে মেডিকার্ট রোবট এবং জীবাণুনাশক রিমোট কন্ট্রোল ইউভি-সি সিস্টেম, ভেন্টিলেটর বা অক্সিজেন সরবরাহকারী যন্ত্র, ফেস প্রটেকটিভ শিল্ড, সেফটি গগলস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও থার্মোমিটার।
এরই মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের প্রায় ৩৬টি প্রতিষ্ঠান পিপিই পণ্য উৎপাদন সক্ষমতার তথ্য জানিয়েছে। তবে প্রায় ২৭ ধরনের পিপিইর সবগুলো তৈরির সক্ষমতা এখনো অর্জন করেনি বাংলাদেশ। শুধু পিপিই নয়, মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ও সলিউশন তৈরি করছে দেশের কিছু প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে ওয়ালটন, মিনিস্টার, স্কয়ার ও এসিআইয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া অতিসম্প্রতি দেশীয় আরেকটি প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাস ধ্বংস করে এমন কাপড় প্রস্তুতের কথা জানিয়েছে। সেই সঙ্গে পণ্যটির বৈশ্বিক চাহিদার ইঙ্গিত দিয়েছে তারা।
পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে নতুন এসব পণ্যের মাধ্যমে রফতানিতে বৈচিত্র্য আসার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রফতানি) ওবায়দুল আজম।তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে সুরক্ষা উপকরণের মতো পণ্যগুলোর ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সুরক্ষা উপকরণ, মেডিকেল ইকুইপমেন্ট, করোনা ধ্বংস করে এমন কাপড়—এই পণ্যগুলো রফতানি ঝুড়িতে নতুন সংযোজন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আগামী এক বছর এ ধরনের পণ্যের চাহিদা থেকেই যাবে। সরকার এ ধরনের পণ্য উৎপাদকদের সহযোগিতায় তাদের পাশে আছে। যদি কোনো ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হয় তা করা হবে। আশা করছি নতুন পণ্যগুলো আগামী দিনগুলোতে ব্যাপক হারে রফতানি বেড়ে যাবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, রফতানিতে বৈচিত্র্য আনবে এমন কিছু পণ্যের চাহিদা এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছে, যেমন নন-ওভেন মাস্ক রফতানি হচ্ছে। ৩৬টি কারখানা আছে যারা কিছু সুরক্ষা উপকরণ বানাচ্ছে, যেমন হ্যান্ড গ্লাভস, জুতার কভার, মাস্ক ইত্যাদি। তবে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠান এন-৯৫ বা কেএন৯৫-এর মতো সনদ দ্বারা স্বীকৃত মাস্ক উৎপাদন করছে, এমন তথ্য নেই। এছাড়া থার্মোমিটার, ভেন্টিলেটরসহ বেশকিছু মেডিকেল ইকুপমেন্টও তৈরি হচ্ছে দেশে। বিদেশীরা যারা বাংলাদেশ থেকে সুরক্ষা উপকরণ নিতে আগ্রহী তারা জানতে চাইছেন পণ্যগুলো সনদপ্রাপ্ত কিনা, মানসম্পন্ন কিনা। সনদসংক্রান্ত কারণেও অনেক পণ্য রফতানি করা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে ওয়ালটনের নির্বাহী পরিচালক উদয় হাকিম বলেন, করোনা প্রেক্ষাপটে চাহিদা বেড়েছে এমন পণ্যের মধ্যে আছে মেডিকেল ইকুইপমেন্ট। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে আমাদের তৈরি ইকুইপমেন্টের বিষয়ে জানানোও হয়েছে। সরকারের সহযোগিতায় অচিরেই পণ্যগুলোর রফতানি করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।
রফতানির ক্ষেত্রে অতিসম্প্রতি যে পণ্যটির চাহিদার বিষয়ে বহির্বিশ্ব থেকে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে সেটি হলো করোনা ধ্বংস করতে সক্ষম এমন কাপড়। পণ্যটি উৎপাদনের ঘোষণা দিয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফ্যাব্রিকস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ঘোষণার পরপরই বিদেশে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলরদের সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন।
জানা গেছে, জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফ্যাব্রিকস লিমিটেড উৎপাদিত করোনাভাইরাস প্রতিরোধী বিশেষ এ কাপড় দিয়ে মাস্ক, পিপিইর মতো সুরক্ষাসামগ্রীর পাশাপাশি শার্ট, প্যান্ট, জ্যাকেটসহ সব ধরনের পোশাক তৈরি করা যাবে। সুইজারল্যান্ডের দুটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় করোনা ব্লক নামের এই বিশেষ কাপড় নিজেদের টঙ্গীর কারখানায় উৎপাদন করেছে জাবের অ্যান্ড জোবায়ের। ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ করোনাভাইরাস এ কাপড়ের সংস্পর্শে আসার ১২০ সেকেন্ড বা দুই মিনিটের মধ্যে ধ্বংস হবে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাবের অ্যান্ড জোবায়েরের সিনিয়র ব্র্যান্ড ম্যানেজার অনল রায়হান বলেন, আড়াই মাসের পরিশ্রমের ফসল এ করোনা প্রতিরোধী কাপড়। এরই মধ্যে বিদেশের পরীক্ষাগারে আইএসও ১৮১৮৪-এর অধীনে কাপড়ের পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। আমরা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কাপড়টি বাজারজাত করার জন্য আন্তর্জাতিক মান সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সনদ নিয়েছি। বর্তমান কঠিন সময় পার করা রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে কাপড়টি বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
করোনা ধ্বংস করে এমন কাপড়ের রফতানি সম্ভাবনার তথ্য জানিয়েছে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোও (ইপিবি)। সংস্থাটি বলছে, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে এরই মধ্যে মাস্ক বা কিছু পিপিই উপকরণ রফতানি শুরু হয়েছে। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোতে সনদের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও পশ্চিমা দেশগুলোতে রফতানির ক্ষেত্রে সনদের বাধ্যবাধকতা চাওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে এমন পণ্যের মধ্যে আছে মেডিকেল ইকুইপমেন্ট।
ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, অতিসম্প্রতি মাস্ক, মেডিকেল ইকুইপমেন্ট জাতীয় পণ্যগুলো রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে। মেডিকেল ইকুইপমেন্টের মধ্যে কিছু পণ্যের রফতানি আনুমানিক ৫ থেকে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এছাড়া পিপিই বা সুরক্ষা উপকরণের রফতানি চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের লক্ষ্যই হলো রফতানি বাস্কেটকে বৈচিত্র্যময় করা। সেই ধারাবাহিকতায় নতুন পণ্য নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি।
এদিকে পিপিইর রফতানি চাহিদা সৃষ্টির কথা বলা হলেও প্রতিবন্ধকতাও আছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের যারা পিপিই তৈরি করছেন, তারা সনদপ্রাপ্ত নন। এগুলো শুধু শতভাগ পানি প্রতিরোধক এবং এর নকশা স্বাস্থ্যবিষয়ক পেশাজীবীরা যে ধরনের পিপিই ব্যবহার করেন তার কাছাকাছি। এই পিপিই পোশাক সেসব ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য তৈরি করা হচ্ছে, যারা আতঙ্কিত হয়ে কর্মস্থলে যেতে ভয় পাচ্ছেন। এই ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আশা করছেন, শুধু যে করোনা উপসর্গধারী রোগীদের চিকিৎসা চলাকালে পিপিই ব্যবহার হবে তা নয়, বরং তারা পেশাগত সব কর্মকাণ্ডে সুরক্ষা পাবেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্মুখ সারির স্বাস্থ্যকর্মীদের কোনো ধরনের সুরক্ষা নেই বলে এরই মধ্যে বিজিএমইএ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবার মহাপরিচালকের (ডিজিএইচএস) কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে স্থানীয় বাজারে বাজারজাত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
পিপিই প্রস্তুতকারকরা বলছেন, পিপিই প্রস্তুত করতে যে ফ্যাব্রিকস ব্যবহার করা হয় তার মেডিকেল গ্রেড থাকে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান বজায় রেখে তা প্রস্তুত করতে হয়। এ ফ্যাব্রিকস মূলত চীন থেকে আমদানি করতে হয়। আবার পিপিই পোশাক তৈরির জন্য কারখানাগুলোকে বিশেষ ধরনের মেশিনারিজ ব্যবহার করতে হবে। কারখানায় জীবাণুমুক্ত পরিবেশে উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এসবের জন্য প্রশিক্ষণও দরকার। সব মিলিয়ে বাংলাদেশী কারখানায় পিপিই তৈরি করার জন্য কমপক্ষে ছয় মাস অথবা এর অধিক সময় লাগবে। উদ্যোক্তারা বিকল্প উৎস হিসেবে চীন থেকে পিপিইর ফ্যাব্রিকস আনছেন। এতে করে লিড টাইম ১৫-২০ দিন লাগবে, যেহেতু বিমানপথে এখন দীর্ঘসূত্রটা অনেক বেশি। যে মুহূর্তে এই আমদানীকৃত ফ্যাব্রিকস উদ্যোক্তাদের হাতে আসবে, তখনই তারা পিপিই তৈরিতে এই ফ্যাব্রিকস ব্যবহার করা শুরু করবেন।
রফতানি খাতের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি সংসদ সদস্য আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, যেখানে সমস্যা থাকে সেখানে একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। সম্ভাবনা আসবে, আসছে সন্দেহ নেই। এখন অনেক বড় মার্কেট শিফট হবে, আমাদের পারফর্ম করতে হবে। আগে টিকে থাকা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্প-কারখানা পর্যায়ক্রমে সচল রেখে নিজস্ব সক্ষমতার প্রকাশ ঘটানো। তারপর নতুন সম্ভাবনা কাজে লাগানো। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আছে ৭৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ। কিছুটা হলেও সহযোগিতা হবে প্রণোদনায়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, পিপিইর মতো সুরক্ষা উপকরণগুলো রফতানিতে সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছে সরকার। এ নিয়ে কাজও শুরু হয়েছে। এছাড়া করোনা প্রেক্ষাপটে বিশ্বে খাদ্যশস্যের উৎপাদনই কমে যাবে আগামী বছরগুলোতে। এ পূর্বাভাসের ফলে খাদ্যশস্য রফতানি নিয়েও কাজ শুরু করেছে সরকার। এক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে আমাদের দেশ থেকে চালের রফতানি বাড়তে পারে। এছাড়া আলুর রফতানি বাড়তে পারে। এরই মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আলু আমদানির বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের সিইও আলী আহমেদ বলেন, কভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে নতুন অনেক পণ্যেরই চাহিদা তৈরি হতে শুরু করেছে। নতুন কোনো পণ্য নিয়ে আমরা গবেষণা না করলেও আশা করছি লেদার, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, প্লাস্টিকজাত পণ্যের ব্যাপক বৈশ্বিক চাহিদা আগামীতে অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য।