ডিভিলিয়ার্স আলোচনায় অাসলেও আসেন নি জাভেদ ওমর
আপডেট: ২০১৫-১২-০৮ ১৯:২৬:১৬
টেস্ট ক্রিকেটের এত দীর্ঘ ইতিহাসে কমপক্ষে ৩৪০ মিনিট ব্যাটিং করার পরও ফিফটি না-করার ইনিংস ছিল একটিই। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা টেস্টে ৩৪০ মিনিট ব্যাটিং করে ৪৩ করেছিলেন জাভেদ। গতকাল শেষ হওয়া দিল্লি টেস্টে ৩৪৫ মিনিট ব্যাটিং করে ঠিক ৪৩ রানই করলেন ডি ভিলিয়ার্স।
কাল ম্যাচটা বাঁচাতে না-পারলেও ডি ভিলিয়ার্সের সঙ্গী হচ্ছে রাশি রাশি প্রশংসা। কী টেম্পারামেন্ট! নিজেদের কী দুর্দান্তভাবেই বদলে ফেলা! অথচ জাভেদের কপালে খুব বেশি প্রশংসা জোটেনি। অথচ ডি ভিলিয়ার্স না-পারলেও জাভেদ পেরেছিলেন!
৩৪০ মিনিট ধরে ব্যাটিং করেও ফিফটি করতে না-পারাকে ব্যর্থতা হিসেবে ধরতে পারেন, যদি ম্যাচের পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকে। দিল্লি টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার মতোই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সেই ম্যাচে বাংলাদেশের লক্ষ্যও ছিল ম্যাচ বাঁচানো। বাংলাদেশের জন্য কাজটা দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে আরও কঠিনই ছিল। অনেকগুলো কারণে।
সেই টেস্ট ড্র করাতে পারলে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ জিতবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের অভিজ্ঞতাই হয়েছে এর মাত্র কয়েক দিন আগে।
জয় তো দূরের কথা, নিজের চেষ্টায় টেস্ট ম্যাচ ড্র করানোর অভিজ্ঞতাই বাংলাদেশের তখন সেই অর্থে ছিল না। ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের স্নায়ু চাপ ছিল কয়েক গুণ বেশি। বাংলাদেশের টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতাই ছিল মাত্র ৫ বছরের। ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের বয়সও খুব বেশি নয়।
সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই বাংলাদেশকে পাড়ি দিতে হতো ১৫০ ওভারের মতো দীর্ঘ একটা পথ। সেটিও ম্যাচের চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে—ক্লান্তি শরীরে ভাঙন ধরিয়েছে, ভাঙন ধরেছে উইকেটেও।
ওই পরিস্থিতিতে ২৫৮ বল খেলে ৪৩ করেছিলেন জাভেদ। ওপেনিংয়ে নাফিস ইকবালকে নিয়ে পার করে দিয়েছেন প্রায় ৮৬ ওভার। সময়ের হিসাবে যা কিনা প্রায় পুরো একটা দিনই! সেই টেস্টে অসাধারণ এক সেঞ্চুরি করেছিলেন নাফিস। এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ৫ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ যে ম্যাচটি ড্র করতে পেরেছিল, সে জন্য সবাই নাফিসকেই বাহবা দেয়। সেটি তাঁর প্রাপ্যও। কিন্তু একবারও উঠে আসে না জাভেদের নাম!
শুধু কি তাই? সেদিনের অমন দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাটিং করার ‘পুরস্কার’ও তাকে হাতেনাতে পেতে হয়েছিল। পরের ওয়ানডে সিরিজেই তিনি বাদ পড়েছিলেন দল থেকে!
কাল সন্ধ্যায় যখন টেলিফোনে কথা হচ্ছিল জাভেদের সঙ্গে, খসখসে কণ্ঠস্বর, জ্বরে কাবু। তবুও প্রায় ১১ বছর আগের সেই দিনটায় তাঁকে ফিরিয়ে নিতেই যেন রোমাঞ্চের উত্তাপে ঘাম দিয়ে ছুটে গেল জ্বর। ‘কেন মনে থাকবে না ওই ইনিংসের কথা? স্পষ্ট মনে আছে। আজীবন মনে রাখব। দেখেন আমার ক্যারিয়ার হয়তো অতটা গ্ল্যামারাস নয়। কিন্তু তার পরও কিছু কিছু অর্জন তো আছেই। ব্যাট ক্যারি করার রেকর্ডও আমার নাম পাবেন। কিন্তু এটা কিছুই না, আমি সব সময়ই বলি, আমার জীবনের সেরা ইনিংস হচ্ছে ওই ৪৩। পত্রিকায় শিরোনামই এসেছিলো—আমার সেরা ওই ৪৩। বাসায় এলে দেখতে পাবেন, তা আমি দেয়ালে টানিয়ে রেখেছি।’
জিম্বাবুয়ে তখন খর্ব শক্তিরই। কিন্তু বাংলাদেশের কাছে টেস্ট ম্যাচ হারবে, টেস্ট সিরিজ হারবে—এটা তখনো তাদের পক্ষে মানা ছিল কষ্টকর। আরও স্পষ্ট করে বললে, অপমানজনক। জাভেদ বললেন, ‘চট্টগ্রামে বাংলাদেশ জেতার পর টাটেন্ডা টাইবু বলেছিল, “এখন হয়তো বাংলাদেশের পতাকা জিম্বাবুয়ের ওপরে আছে, কিন্তু ঢাকা টেস্টের পর জিম্বাবুয়ের পতাকা আবার ওপরে চলে যাবে। ” ওর কথাটা আমার খুব গায়ে লেগেছিল। খুব জেদ চেপে গিয়েছিল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এই সিরিজ আমরা জিতবই। জিতবই।’
ডি ভিলিয়ার্সও ২০১২ সালে অ্যাডিলেডে ম্যাচ বাঁচানোর একটা লড়াইয়ে ২২০ বল খেলে ৩৩ রান করেছিলেন, চার মারেননি একটিও। সেটি জানাতেই জাভেদ বললেন, ‘নিজেকে ডি ভিলিয়ার্সের সঙ্গে তুলনা করব না। কিন্তু দেখুন, তার মতো আক্রমণাত্মক ক্রিকেটারও দলের প্রয়োজনে কী রকম বদলে যায়। দলটাই আসল, নিজের জন্য হাততালিটা দিন শেষে কিছুই না।’
এ কারণেই জাভেদের আক্ষেপ নেই। তিনি জানেন, সবাই সম্রাট শাহজাহানের কথা বলে, কিন্তু তাজমহল বানিয়েছে আসলে নাম না-জানা কত হাজার-লক্ষ শ্রমিক, তাদের শ্রমে-ঘামে। জাভেদ, একজন শিল্পিত-শ্রমিক। কোনো দিন ডি ভিলিয়ার্সের সঙ্গে দেখা হলে এই রেকর্ডের প্রসঙ্গটা তুলবেন না? জাভেদের রসিকতা, ‘পিঠ চাপড়ে দেব। আমি ৩৪০ মিনিট খেলেছি, ও খেলেছে ৩৪৫ মিনিট, ৫ মিনিট বেশি! তবে বলব, শেষ পর্যন্ত তো পারলা না ম্যাচ বাঁচাইতে। টিপস লাগবে? হা হা হা…।’
জাভেদ তাই এখনো হাসতে পারেন তাঁর সেই সব ইনিংস নিয়ে। জাভেদ তাই এখনো গর্ব করে বলতে পারেন, ৩৪০ মিনিট ধরে খেলে ৪৩ রানই আমার সেরা। কারণ এই ‘৪৩’ এর দিকে তাকালে তিনি ‘৪’ আর ‘৩’ দেখেন না। দেখেন, জিম্বাবুয়ের ওপরেই পতপত করে উড়ছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা!
সানবিডি/ঢাকা/রাআ