অনলাইন ক্লাসঃ প্রশাসনের সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি প্রকাশ: ২০২০-০৮-১৬ ১১:২৫:১৩
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি) অনলাইনে শ্রেণি কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, সমস্যায় থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের বিবেচনার বাহিরে রেখেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সমস্যা সমাধান পূর্বক অধিকাংশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেই অনলাইন কার্যক্রমে যেতে চান নোবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা।
গত ৯ আগস্ট (রোববার) বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অনলাইনে চলমান সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা ব্যতীত সব কার্যক্রম সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এই সভায় ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী সেমিস্টারের কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে দুই সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা একসাথে নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে উক্ত সভায়। সভার একাধিক সূত্র এই বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন।
সভা সূত্র জানিয়েছে, সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে করোনা পরিস্থিতি এবং সরকারি সিদ্ধান্তের উপর। তারা বলেন, সহসায় বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হলে প্রশাসন এই বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করবে। এক্ষেত্রে পূর্বের সেমিস্টার পূর্ণাঙ্গ শেষ করে পরবর্তী সেমিস্টারে যাওয়া হবে। আর খোলা না হলে ২য় সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা ব্যতীত বাকি কার্যক্রম অনলাইনে চালিয়ে নেওয়া হবে।
প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থী প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্ত সেশনজট থেকে রেহাই দিবে। যেহেতু চাকরীর ক্ষেত্রে বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেহেতু যত দ্রুত আমরা আমাদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পাঠ শেষ করতে পারবো ততই মঙ্গল।
তাদের মতে, এক্ষেত্রে প্রয়োজন সিলেবাস কমিয়ে পরীক্ষা নেওয়া এবং সময়টা আরো একটু বাড়িয়ে দেওয়া। নয়তো তা শিক্ষার্থীদের জন্য চাপ সৃষ্টি করবে।
আবার, অনেকে মনে করছেন সিলেবাস কমিয়ে পরীক্ষা কোনভাবেই মঙ্গলজনক নয়। কারণ এতে শিক্ষার গুণগত মান বজায় থাকেনা। এছাড়া অন্যান্য নানাবিধ সমস্যার কারণে শুধুমাত্র অনলাইনে পুরো সেমিস্টার শেষ করারও বিপক্ষে রয়েছেন শিক্ষার্থীদের একাংশ। প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক এর চেয়ে নেতিবাচক প্রভাবই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
জানা যায়, এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো বিভাগ পুরোদমে ক্লাস শুরু করেনি। কোন কোন বিভাগে মাত্র ১-২ টি কোর্সের ক্লাস চলমান। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহ এবং নানাবিধ সমস্যার কারণেই সেসকল বিভাগের শিক্ষকরা ভালোমত ক্লাস শুরু করতে পারেন নি। প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়ে এসকল বিভাগের শিক্ষকরা পুরোদমে ক্লাস নেয়া শুরু করলেও প্রশাসনের বেঁধে দেয়া এত কম সময়ে কোর্সগুলো সম্পূর্ণভাবে শেষ করা সম্ভব নয়।
আবার কিছু কিছু বিভাগে পুরোদমে ক্লাশ শুরু হলেও উপস্থিতি ৫০-৫৫ শতাংশ। দেখা যায় যে বাকি শিক্ষার্থীদের এমন অনেকেই আছেন যারা এখন পর্যন্ত একটি ক্লাসেও উপস্থিত হয়নি। সেক্ষেত্রে ক্যাম্পাস খোলার পরপরই কিংবা ১ মাস পরে পরীক্ষা নেয়া হলে ক্লাস না করা শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে পরীক্ষার জন্য তৈরী করতে ব্যর্থ হবে এবং পরীক্ষায় বসলেও আশানুরূপ ফলাফল অর্জন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শুধুমাত্র সেমিস্টার ফাইনাল ব্যতীত বাকি সকল কার্যক্রম অনলাইনে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ক্লাস টেস্ট, এসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশন যদি অনলাইনে নেয়া হয় তাহলে ক্লাস না করা শিক্ষার্থীরা অনেকাংশে পিছিয়ে যাবে।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা ডিভাইস সমস্যা, নেটওয়ার্ক সমস্যা, ঘন ঘন লোডশেডিং, এবং মোবাইল কোম্পানিগুলোর নেট দুর্বলতার কারণে সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিয়মিত অনলাইন ক্লাশে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষা সবার জন্য। কিন্তু অনলাইন পদ্ধতিতে শ্রেনিকার্যক্রম আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি করছে। নেটওয়ার্ক সমস্যাজনিত কারণে ক্লাস না করতে পারা বেশ কিছু শিক্ষার্থী বলেন, “আমরা যারা ক্লাস করতে পারছিনা তাদেরকে যদি ক্লাসের ভিডিও, ক্লাস লেকচারের সফটকপি দেয়া হয় তাহলে সুবিধাজনক সময়ে সেগুলো দেখে আমরা পড়াশোনার মধ্যে থাকতে পারবো এবং কিছুটা হলেও উপকৃত হবো।”
নিয়মিত অনলাইন ক্লাশে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের মতে, ক্যাম্পাসের নিজ ডিপার্টমেন্টের ক্লাসরুমে বসে ক্লাশ করা আর অনলাইনে ক্লাস করার মধ্য রয়েছে বিরাট প্রভেদ। অনলাইনে সব বিষয়গুলো যথার্থভাবে বুঝা সম্ভব হয়না। এই পদ্ধতির ক্লাসে শিক্ষকের সাথে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগও খুব কম পাওয়া যায়। আবার ব্যবহারিক ক্লাসগুলো তো অনলাইনে করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে ক্যাম্পাস খুললে প্রয়োজন যথেষ্ট সময় এবং অন্যান বিষয়ের জন্যও প্রয়োজন রিভিউ ক্লাস।
এছাড়াও উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাসায় বসে শতভাগ মনযোগ দিয়ে পড়াশুনা করাটাও অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পক্ষে সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি। শুধুমাত্র সেশনজট থেকে মুক্তি পেতে এমন সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন শিক্ষার গুণগত মানকে ব্যাহত করে অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। এতে করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা কাজ করতে পারে এবং সিজিপিএ খারাপ হওয়ার আশংকাও থাকবে।
সেপ্টেম্বরে ক্যাম্পাস খুললে চলমান সেমিস্টারের পরীক্ষা এবং বিলম্ব হলে পরবর্তীতে দুটি সেমিস্টারের পরীক্ষা একসাথে নেয়া হবে- প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে কোনভাবেই একমত পোষন করছেন না বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই। সেপ্টেম্বরে ক্যাম্পাস খুললেও পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় চাইছেন তারা। করোনাকালীন সময়ে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। নিজেদেরকে মানসিকভাবে তৈরী করার জন্যও সময় প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের। সকল শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা এবং সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে প্রশাসনের কাছে জোর অনুরোধ জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা। প্রশাসন যদি শিক্ষার্থীদের সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারেন তাহলে অনলাইন শ্রেনিকার্যক্রম নিয়ে শিক্ষার্থীদের কোন দ্বিমত থাকবেনা।
প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষন করে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি তাদের নিজস্ব ফেসবুক পেইজ থেকে পোল গঠন করে
অনলাইনে ভোট নেয় এবং এই ব্যাপারে ছাত্র-ছাত্রীদের মতামত নিয়েছে। এতে অংশগ্রহণ কারী শিক্ষার্থীদের ৭৮ শতাংশই এ অবস্থায় ক্লাস করতে চান না। প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্লাস করার পক্ষে ৩১৬ জন হ্যাঁ ভোট দিলেও অংশগ্রহণ কারী প্রায় ১৫শ শিক্ষার্থীর বাকি সবাই বিপক্ষে তথা না ভোট দিয়েছে। এদের বেশিরভাগই চান এই সমস্যা গুলোর সমাধান দিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম চালানোর ব্যাপারে স্পস্ট বিজ্ঞপ্তি প্রদান করা হোক।
দীর্ঘসময় শিক্ষা কার্যক্রমের বাহিরে থেকেছে শিক্ষার্থীরা, এতে তারা পিছিয়ে পড়বে বলে মনে করেন নোবিপ্রবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও প্রক্টর অধ্যাপক ড. নেওয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুর। তিনি বলেন, ধীরে ধীরে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে সমস্যায় থাকা শিক্ষার্থীদেরকে নিয়েও বিভাগীয় শিক্ষকদের ভাবতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বিভাগসমূহ উদ্যোগ নিয়েই শিক্ষার্থীদের ডাটা সমস্যার সমাধান করে ক্লাসে নিতে পারেন। আর দূর্বল নেটের শিক্ষার্থীদের জন্য সহনশীল হতে হবে শিক্ষকদেরকে। এক্ষেত্রে তাদের উচিৎ, একদিন আগে লেকচারের সফটকপি দিয়ে দেওয়া এবং ক্লাস রেকর্ড দিয়ে বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সুবিধামত সময়ে পাঠ গ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া।
তিনি আরো জানান, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইউজিসিতে নির্ভুল তালিকা পাঠিয়ে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের ডিভাইস সুবিধা পেতে সহায়তা করা হবে, যেন তারাও এই পদ্ধতির ক্লাস থেকে বঞ্চিত না হয়। সর্বোপরি ক্লাস টেস্ট ও এসাইনমেন্ট নেওয়া সহ সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদেরকে সহনীয় পর্যায়ে থেকে পাঠদান করতে বলেন নোবিপ্রবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি।
শিক্ষার্থীদের ভালোর জন্যই অনলাইন শ্রেণি কার্যক্রম চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান নোবিপ্রবি উপাচার্য প্রফেসর ড. মো দিদার-উল-আলম। তিনি বলেন, যেহেতু শিক্ষার্থীদের কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এটি যেন আবার তাদের অসুবিধার সৃষ্টি না করে। সেজন্য তিনি শিক্ষকদের নির্দেশ দেন, ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করেই যেন কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হয়। সমস্যায় থাকা শিক্ষার্থীরা যেন কোন প্রকার হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখে শিক্ষকদের অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেন উপাচার্য।
সানবিডি/এসকেএস