লাশ দাফনে বিলম্বঃ ইসলাম কি বলে?
সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২০-০৮-১৬ ১৩:১৬:১২
মৃত্যু চিরন্তন সত্য।তা অস্বীকার করার শক্তি কারো নেই।আর ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা।এতে রয়েছে মানুষের জন্ম,মৃত্যু এবং মৃত্যুর পর কবরস্থ করা, মোটকথা ইসলামে রয়েছে জীবনের সকল বিষয়ের দিকনির্দেশনা।কোন মুসলমান মৃত্যুবরণ করার পর তার মৃত্যুপরবর্তী কাজগুলো ধর্মীয় বিধি-বিধানের আলোকেই সম্পাদন করাই ইসলামের শিক্ষা।কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের দেশে কোন মুসলমান মৃত্যুবরণ করার পর থেকে নিয়ে কবরস্থ করা পর্যন্ত এমন কিছু প্রথা চালু আছে যা আদৌ শরীয়ত সম্মত নয়।
আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে যে প্রথাটি চালু আছে তা হলো, সঙ্গত কারণ ছাড়াই অনর্থক লাশ কাফন-দাফন করার ক্ষেত্রে বিলম্ব করা হয়। সমাজে যিনি যত বড় হয়ে থাকেন তার লাশ কাফন-দাফনে তত বেশি বিলম্ব করা হয়। ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যদি কেউ দেশের বাইরে থাকে, তাহলে তাদের দেশে ফেরা পর্যন্ত লাশ দাফন করা হয় না। বরং মৃতব্যক্তিকে হাসপাতালের হিমঘরে রেখে দেওয়া হয়। অনেক সময় দেখা যায় ভিসা জটিলতার কারণে আত্মীয়-স্বজনদের দেশে ফিরতে দু’চার দিন বা দু’এক সপ্তাহ দেরি হয়। এতদিন পর্যন্ত লাশ কবরস্থ করা হয় না। কিন্তু লাশ কাফন-দাফনের ক্ষেত্রে এ ধরণের বিলম্ব করার কোন অনুমতি ইসলামে নেই। বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাষায় বিলম্ব করা থেকে নিষেধ করেছেন।
হাদীসে মৃত্যুর পর বিলম্ব না করে কাফন, জানাযা দ্রুত সম্পন্ন করে তাড়াতাড়ি দাফন করে দেওয়ার তাকিদ করা হয়েছে।
১. রাসূল সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
انّ طلحة بن البراء رضى الله عنه مرض فاتاه النبى عليه السلام يعوده فقال انى لارى طلحة الا قد حدث فيه الموت فاذنونى به وعجّلوا فانه لاينبغى لجيفة مسلم ان تحبس بين ظهرانى اهله ـ
অর্থ ঃ হযরত তালহা রা. অসুস্থ ছিলেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য আসলেন। অতঃপর তাঁকে দেখে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তো দেখছি সে মারা গেছে। তোমরা খুব দ্রুততার সাথে কাফন-দাফনের ব্যবস্থা কর এবং আমাকে সংবাদ দাও। কারণ, কোন মুসলমানের লাশ মৃত্যুর পর ( দ্রুত কবরস্থ না করে) তার পরিবারের মাঝে ফেলে রাখা ঠিক নয়। (আবু দাউদ শরীফ, খ: ২, পৃ: ৪৫০)
২. রসূলুল্লাাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাাাম আরো ইরশাদ করেন।
عن عبد الله بن عمر رضى الله عنه قال سمعت النبى صلى الله عليه وسلم يقول اذا مات احدكم فلا تحبسوه و اسرعوا به الى قبره وليقرأ عند رأسه فاتحة البقرة وعند رجليه بخاتمة البقرة ـ
অর্থ ঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি যে, তিনি ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে যখন কোন ব্যক্তি ইন্তেকাল করে তখন তাকে তোমাদের মাঝে আটকে রেখ না বরং তোমরা তাকে অতি দ্রুত কবরস্থ করার জন্য কবরের দিকে নিয়ে যাও এবং তার মাথার দিকে দাঁড়িয়ে সূরা বাকারার প্রথম অংশ এবং পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে সূরা বাকারার শেষের অংশ পাঠ কর। (বাইহাকী শরীফ, মিশকাত শরীফ, খ: ১, পৃ: ১৪৯)
৩. আরো একটি হাদীসে এসেছে।
عن على بن ابى طالب رضى الله عنه انّ رسول الله صلى الله عليه وسلم قال له يا على ثلاث لاتؤخرها الصلوة اذا انت والجنازة اذا حضرت والايّم اذا وجدت لها كفوًا ـ
অর্থঃ হযরত আলী রা. সূত্রে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রা. কে লক্ষ্য করে বলেন, ‘হে আলী! ৩টি জিনিসের ক্ষেত্রে বিলম্ব করবে না। ১. নামাযের যখন সময় আসবে তখন নামায আদায় করা থেকে দেরি করবে না। ২. মৃত ব্যক্তির জানাযা যখন উপস্থিত হবে তখন কাফন-দাফন সম্পন্ন করতে দেরি করবে না। ৩. কোন অবিবাহিতা মেয়ের জন্য যখন কোন উপযুক্ত পাত্র পাবে তখন তাকে পাত্রস্থ করা থেকে বিলম্ব করবে না।’ (তিরমিযী শরীফ, খ: ১, পৃ: ২০৬)
৪. আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লালাম বলেন।
عن ابى هريرة رضى الله عنه عن النبى عليه السلام قال اسرعوا بالجنازة فان تك صالحة فخير تقدموها وان تك سوى ذلك فشر تضعونه عن رقابكم ـ
অর্থ ঃ হযরত আবু হুরায়রা রা. সূত্রে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা মৃত ব্যক্তির জানাযার খাটলি নিয়ে দ্রুতবেগে যাও (কবরস্থ করার জন্য)। কারণ, মৃত ব্যক্তি যদি নেক্কার হয় তাহলে তো তোমরা তাঁকে কল্যাণের নিকটবর্তী করে দিলে, আর যদি সে নেক্কার না হয় তাহলে এক অকল্যাণকে তোমাদের কাঁধ থেকে নামিয়ে দিলে। (বুখারী শরীফ, খ: ১, পৃ: ১৭৬)
উপরোক্ত হাদীসে মৃত্যুর পর বিলম্ব না করে কাফন, জানাযা দ্রুত সম্পন্ন করে তাড়াতাড়ি দাফন করে দেওয়ার তাকিদ করা হয়েছে।
এ সংক্রান্ত দলিলের আলোকে ফকীহগণ মৃতের গোসল, কাফন-দাফন ও জানাযা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ দ্রুত সম্পন্ন করাকে উত্তম বলেছেন এবং বিনা ওজরে বিলম্ব করাকে মাকরূহ বলেছেন।
অতএব শরীয়তের উক্ত নির্দেশনার প্রতি সকলকে যত্নবান হতে হবে।
তাই স্বাভাবিক সময়ের ভিতরে মৃতের জানাযা-দাফনের প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হয়ে গেলে মৃতের ওলি উপস্থিত লোকদেরকে নিয়ে জানাযা পড়ে দ্রুত দাফন করে দিবে। এ সময়ের ভিতর কোনো আত্মীয়-স্বজন বা বিশেষ কোনো ব্যক্তির উপস্থিত হওয়া সম্ভব না হলে তার জন্য বিলম্ব করা সমীচীন হবে না।
অবশ্য ওলি নিজেই যদি দূরে অবস্থান করার কারণে স্বাভাবিক সময়ের ভিতরে তার উপস্থিত হওয়া সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে ওলির জন্য উচিত তো এটাই যে, তার জন্য অপেক্ষা করতে না বলে দ্রুত দাফন করে দিতে বলবে। এতে শরীয়তের হুকুমের প্রতি যথাযথ আমল হবে।
কিন্তু ওলি যদি তার জন্য অপেক্ষা করতে বলে তাহলে তার জন্য বিলম্ব করার অবকাশ রয়েছে। অবশ্য এক্ষেত্রেও এ পরিমাণ বিলম্ব করার অবকাশ নেই, যার কারণে লাশের মধ্যে পরিবর্তন হওয়ার আশংকা হয়। এত অধিক বিলম্ব করা ওলি-গায়রে ওলি কারো জন্যই জায়েয নয়।
আর দাফনে দীর্ঘ বিলম্বের উদ্দেশ্যে লাশের পরিবর্তন ও বিকৃতি রোধে লাশকে হিমাগারে রাখা, ফর্মালিন মেডিসিন ইত্যাদি পচনরোধক ঔষধ দিয়ে রাখা জায়েয নয়; বরং লাশের স্বাভাবিক অবস্থা পরিবর্তন হওয়ার পূর্বেই দাফন করে দেওয়া জরুরি। এর অধিক বিলম্ব করা গুনাহ।
এছাড়া মৃতদেহকে হিমাগারে রাখা ফর্মালিন, মেডিসিন ইত্যাদি দিয়ে রাখা সম্মানপরিপন্থী ও কষ্টদায়ক। অথচ মৃত ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা জরুরি।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, কোনো মুমিন ব্যক্তিকে তাঁর মৃত্যুর পর কষ্ট দেওয়া তেমনই যেমন জীবিত অবস্থায় তাকে কষ্ট দেওয়া।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ১১৯৯০
এ সংক্রান্ত হাদীস ও আছারের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজার রাহ. বলেছেন, জীবিত ব্যক্তি যে সকল বস্ত্ত দ্বারা আরাম বোধ করে মৃত ব্যক্তি তা দ্বারা আরাম বোধ করে। ইবনুল মালাক রাহ. বলেছেন, মৃত ব্যক্তি কষ্টদায়ক বস্ত্ত দ্বারা কষ্ট পায়। (মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/১৭০) তাই মৃত ব্যক্তিকে হিমাগারে রাখা মূলত তাকে কষ্ট দেওয়ারই নামান্তর। এসব কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।
অনুরূপ লাশ জানাযা-দাফনের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে যাওয়ার পর সামাজিক, রাজনৈতিক বা দলীয় প্রথা পালনের উদ্দেশ্যে লাশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কর্মকান্ড করা যেমন, লাশকে স্থানে স্থানে নিয়ে প্রদর্শন করা, শ্রদ্ধা নিবেদন করা, পুষ্পস্তবক অর্পণ করা, ভিডিও করা, লাশকে সামনে রেখে দীর্ঘ সময় ধরে জীবনালোচনা করা, বিভিন্নমুখী ভাষণ-বক্তৃতা দেওয়া ইত্যাদি সবই গর্হিত। এগুলোর মধ্যে জীবিত মৃত কারোরই কোনো কল্যাণ নেই। এসব অনর্থক ও বেহুদা কর্মকান্ড পরহেয করা সকলের জন্য জরুরি।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সমস্ত প্রথা থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুক। আমীন।
লেখক:মুফতী মাহমুদ হাসান।