মুহররম মাসের ফজিলত ও আমল
:: আপডেট: ২০২০-০৮-১৯ ০৭:১৮:১৪
আল্লাহ তাআলা কিছু দিনকে কিছুদিনের উপর, কিছু মাসকে কিছু মাসের উপর এবং কিছু সময়কে সময়ের উপর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর প্রতিটি ফজিলতমন্ডিত মাস,সময়, দিনে কিছু আমল নির্ধারণ করেছেন। এবং নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।মাস সমূহের মধ্যে মহররম মাস সম্মানিত মাস এবং আশুরার একদিন বরকতময় দিন গুলোর মধ্যে একটি।
আসুন জেনে নেই মহররম মাসের ফজিলত এবং আমল।
মুহররম মাসের ফজিলত:
আল্লাহ তায়ালা মুহররমকে অনেক ফজিলত দান করেছেন: তন্মধ্যে কিছু উল্লেখ করা হলো।
(১) মুহররম এর প্রথম ফজিলত ও তাৎপর্য হলো, হিজরী বছরের সূচনা এই মাস থেকেই শুরু হয়, অর্থাৎ ১২ মাসের মধ্যে এটি প্রথম মাস।সমস্ত মুসলিম এতে ঐক্যমত পোষণ করেছেন।
(২) এই মাসটি বছরের সম্মানিত চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে একটি।আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন: “নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গননায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৩৬)
(৩) এই মাসে রোজা রাখা অন্যান্য মাসের চেয়ে উত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “রামাদানের পর সর্বোত্তম রোজা মুহররম মাসের এবং ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হল রাতের নামাজ। ( সহিহ মুসলিম: ১২০২, – সুনান আবু দাউদ: ২৪২৯, – সুনান আল-তিরমিযী: ৭৪০,)
আবু হুরায়রা বর্ণনা করেছেন। একজন সাহাবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেসা করলেন যে রামাদানের পরে সর্বোত্তম রোজা কোনটি? তিনি বললেনঃ আল্লাহর মাসের রোজা। যে মাসকে তোমরা মুহররম মাস নামে জান।( সুনান আল-নিসা’ই আল-কুবরা: ২৯০৬, খণ্ড ২/১৭১)
(৪) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসটিকে “আল্লাহর মাস” বলে উল্লেখ করেছেন, যদিও সমস্ত মাস আল্লাহ তাআলার সৃষ্ট এবং তিনারই। কিন্তু এই মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদার কারণে আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করেছেন।আর এটা স্পষ্ট কথা যে আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলি সম্মানজনক এবং শ্রেষ্ঠতর। যেমন বাইতুল্লাহ, কাবাতুল্লাহ ইত্যাদি।
(৫) এই মাসে আশুরার দিন রয়েছে, যে দিনের রোযা এক বছরের গুনাহের কাফফারা।এ মর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আশুরার রোজা সামনের এবং পিছনের একবছরের গুনাহের কাফ্ফারা।(সহিহ মুসলিম: ১১৬২, রোজা – সুনান আল-তিরমিযী
: ২৫২)
এই মাসের বিশেষ কিছু আমল:
এ মাসের গুরুত্ব ও ফজিলতের কারণে কিছু আমলে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যথাক্রমে
(১)এ মাসে বেশি বেশি রোজা রাখা:
মুহররমের রোজা সম্পর্কে দুটি হাদীস ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, যা দ্বারা বুঝা যায় নফল রোজার মধ্যে সর্বোত্তম রোযা মুহররম মাসের রোজা।
মহররম মাসে রোজার ফজিলতের কারণ:
উলামায়ে কেরাম বলেছেন এই মাসে রোজার ফজিলতের দুটি কারণ রয়েছে:
(ক) যেহেতু এই মাসটি বরকতময় (কারণ এটি পবিত্র মাস )এবং রোজাও আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় আমল, তাই বরকতময় দিনে আল্লাহর প্রিয় আমলের উত্সাহিত করা হয়েছে।
সময়, স্থান এবং অবস্থার প্রেক্ষিতে আমলের গুরুত্ব ও ফজিলত বৃদ্ধি পায়।
(খ) এটি বছরের প্রথম মাস।আর শরীয়ত কোন জিনিসের শুরুতে এবং শেষে ভালো কাজ করার উত্সাহিত করেছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন
وَاَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَیِ النَّھَارِ وَزلَفًا مِنَ اللَّیلِ اِنَّ الحَسَنَاتِ یذھِبنَ السَّیِئَاتِ ذَلِکَ ذِکرَی لِلذَّا کِرِینَ(114) ]۔ ھود
অর্থাৎ এবং দিনের উভয় প্রান্তে এবং রাতের বেলাও নামায কায়েম করুন। নিশ্চয় নেক আমল মন্দ কাজকে মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ গ্রহণ করে তাদের জন্য এটি একটি উপদেশ।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস গুলিতে সকাল-সন্ধ্যা আল্লার জিকিরের উৎসাহিত করা হয়েছে। রসুল ল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে নামাজ পড়েছ( দিনের শুরু, শেষ)। সে কখনই জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। (সহিহ মুসলিম: ৬৩৩৪, মসজিদ- সুনান আবু দাউদ: ৪২৭)
হাদীসে কুদসীতে এসেছে, মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: হে আদম সন্তান! দিনের প্রথম অংশে, আমার সন্তুষ্টির জন্য চার রাকাত নামায পড়,কারণ এই আমলের করণে আমি শেষ অংশ পর্যন্ত তোমার জন্য যথেষ্ট হবো। (সুনানে আবু দাউদ: ১২৮৯, – মুসনাদে আহমদ: ২৮৬/৫)
এজন্য আপনি দেখতে পাবেন হিজরী বছরের প্রথম মাস এবং শেষ মাস উভয়ই সম্মানিত এবং ফজিলতমন্ডিত।উভয় মাসে নেক আমলের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
(২) মুহাররম মাসে গুনাহ থেকে বিরত থাকা:
এই বরকতময় মাসের দ্বিতীয় আমলটি হলো। গুনার কাজ না করা। অর্থাৎ বেশি বেশি নেক কাজ করা এবং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন
[فلَاَ تَظلِموا فِیھِنَّ اَنفسَکم] {التوبة:36)
অর্থাৎ পবিত্র মাসগুলিতে নিজের উপর জুলুম, অন্যায় করবেন না।”( সূরা তাওবা ৩৬)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাসির রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু লিখেছেন: “অর্থাৎ যুদ্ধ বা গোনাহের দ্বারা নিজের প্রতি জুলুম, অন্যায় করবেন না, কারণ এই মাসে পাপ করা অন্য মাসের চেয়েও জঘন্যতম, যেমন মসজিদে হারামে গুনাহ করা। অন্য জাগায় গুনাহ করার চেয়ে বেশি জঘন্যতম এবং খারাপ।
(৩)এ মাসে বেশি বেশি তওবা,ক্ষমা প্রার্থনা করা:
যেহেতু এই মাসে বেশি বেশি রোজা রাখা প্রমাণিত এবং আল্লাহ তায়ালার নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকার বিশেষ নির্দেশ রয়েছে।যদি কোন মুমিন বান্দা এই দুই কাজের সাথে সাথে মহান রবের কাছে নিজের পিছনের সমস্ত গুনাহ থেকে তওবা করে, তাহলে আশা রাখা যায় আল্লাহতায়ালা তাঁর তওবা কবুল করবেন।
এ সম্পর্কে মুসনাদে আহমাদ গন্থে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে
হযরত আলী রাঃ কে কোন এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন রমজানের পরে, আপনি কোন মাসে আমাদেরকে রোজা রাখার পরামর্শ দিবেন? তখন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন এমন একটি প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে করা হয়েছিল তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উত্তরে বলেন রমজানের পরে যদি তোমরা রোজা রাখতে চাও,তাহলে তোমরা মহররম মাসে রাখবে। কেননা এটি আল্লাহর মাস। এই মাসে আল্লাহ তাআলা এক কওমের তওবা কবুল করেছেন এবং অন্যান্য জাতির তাওবা অনুশোচনা কবুল করবেন।
(মুসনাদে আহমদ: ১/১৫৪ – সুনান আল-তিরমিযী:৭৪১)
(৪) ঐক্যবদ্ধ হওয়া:
মতবিরোধ,শত্রুতা, ঘৃণা সব ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। কেননা আল্লাহ তায়ালার সাহায্য পরস্পর মতবিরোধ, শত্রুতা,ঘৃণা ইত্যাদির কারণে আসেনা। আল্লাহ করছেন
[وَقَاتِلوا المشرِکینَ کَافَّةً کَمَا یقَاتِلونَکم کَافَّةً وَاعلَموا اَنَّ اللہَ مَعَ المتَّقِینَ] التوبة:36
অর্থাৎ তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুশরিকদের সাথে লড়াই করো ।যেরকম ভাবে মুশরিকীন ঐক্যবদ্ধ হয়ে তোমাদের সাথে লড়াই করছে আর মনে রেখো নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা পরহেজগারদের সাথেই আছেন। (সূরা তাওবা ৩৬)
আজ মুসলিম দেশে দেশে, দিকে দিকে জায়গায় জায়গায় নির্যাতিত তাই আসুন এই পবিত্র মুহররম মাসে ঐক্যের ছায়া তলে আসি।
(৫) আল্লাহর উপর ভরসা ও আস্থা রাখা:
মুহররম মাস আসার সাথে সাথে হযরত মূসা (আঃ) এবং তাঁর সম্প্রদায়ের কথা স্মৃতিষ্পটে ভাসে যে আল্লাহতায়ালা কিভাবে হযরত মূসা (আঃ) এবং তাঁর সম্প্রদায়কে অত্যাচারীর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।যখন হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ফেরাউনের অত্যাচার থেকে
বাঁচতে মিশর ছেড়ে অনেক দূরে সমুদ্র উপকূলে আসেন তখন সেনাবাহিনী পিছন থেকে ধাওয়া করে এবং খুব কাছাকাছি চলে আসে আর তখন বনি ইসরাইল ভীতসন্ত্রস্ত হন আর বলতে থাকেন হে পয়গম্বর সামনে সাগর পিছনে শত্রুবাহিনী এবার তো আমাদেরকে মেরে ফেলবে।
কিন্তু এমন একটি কঠিন সময়েও হযরত মূসা (আঃ) সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা করেছিলেন। তিনি হাল ছাড়েন নি এবং তাঁর লোকদের একটি বিশ্বস্ত জবাব দিয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন: ”کلا ان معی ربی سیھدین“ الشعرائ: 6
অর্থাৎ ‘অবশ্যই না, বিশ্বাস করো! আমার পালনকর্তা আমার সাথে আছেন যিনি আমাকে পথ প্রদর্শন করবেন। (সূরা শুরা৬)
মহান আল্লাহ তায়ালা আদেশ করলেন যে মূসা! এখন এই সমুদ্রে লাঠি দিয়ে আঘাত করুন, আপনার জন্য একটি নয়,বারোটি পথ বের হবে।
এই হলো এই বরকতময় মাসের শরিয়ী মর্যাদা। কিন্তু সাধারণ মুসলমানরা এই মাসকে বিদআতের মাস বানিয়েছে এবং অনেক সাধারণ মুসলমান মনে করেন যে মুহররম মাসটি অশুভ যা বিবাহ এবং কোন ব্যবসা শুরু করা উচিত নয়।এবং কিছু লোক মনে করেন কারবালার দুর্ঘটনার কারণেই এই মাসটির তাৎপর্য মন্ডিত হয়েছে। নাউজুবিল্লাহ। এমন ধারণা করা ঠিক নয়।
মুহাররম মাসে কিছু বর্জনীয়:
মুহাররম মাস আসলেই এক শ্রেনীর লোকেরা না বুঝে ইমাম ইয়াযিদকে গালিগালাজ করে থাকে আর হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যু শোকে শোক গাঁথা রচনা করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকে। মুহাররমের তাজিয়া, নিশানা, মার্সিয়া, বাদ্য, আত্মপ্রহার দ্বারা শোক পালন এবং অন্যান্য সমারোহ ও এ সবের মধ্যে মাতম করা জাহেলিয়াতের প্রথা ছাড়া আর কিছুই না। হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুর জন্য ঐ দিনে অথবা আর কারো জন্য অন্য কোন দিনে শোক পালন ও মৃত্যু দিবস পালন করা বিদআত। আশুরার দিনকে শিয়া সম্প্রদায় শোক পালনের দিন রূপে গ্রহণ করে আহাজারী, কান্নকাটি এমনকি মুহাররমের প্রথম দিন হতে হাত দ্বারা বুক চাপড়িয়ে, লোহা, ছুরি বা অন্য কিছু দ্বারা পিঠে আঘাত করে রক্ত প্রবাহিত ইত্যাদি করে থাকে। অপর দিকে ঐ দিনকে নাসেবী সম্প্রদায় যারা আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর বংশধরের প্রতি বিদ্বেষ রাখে তারা ঈদ বা খুশীর দিন রূপে গ্রহণ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন; আলোক সজ্জা, খাওয়া দাওয়া, পটকা বাজি ইত্যাদি করে থাকে।
আসুন আমরা মুহাররমের ফজিলত জেনে আমল করি এবং বিদয়াত থেকে বেঁচে থাকি। হে আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন।
মুফতী মাহমুদ হাসান।
*দারুল হাদীস (এম.এ,ইসলামিক স্টাডিস)
জামিয়াতুল আবরার বসুন্ধরা ঢাকা।
*আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ(অনার্স) ঢাকা।
*দারুল ইফতা (ইসলামিক আইন ও গবেষণা বিভাগ) ঢাকা।