যেই ভুলে মুনাফা নিতে পারেনা বিনিয়োগকারীরা: শফিকুল ইসলাম

সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২০-০৯-২০ ১০:৩১:১৮


পৃথিবী জুড়েই সকল শেয়ার মার্কেট থেকে প্রাপ্তির মাত্রা বিনিয়োগকারীভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। অভিজ্ঞ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা যে হারে লাভের মুখ দেখেন স্বল্প পুঁজির সাধারন বিনিয়োগকারীরা তার ধারে কাছেও যেতে পারেন না। ছোট বিনিয়োগকারীদের অনেকে লাভ দেখা তো দূরের কথা -পুঁজি হারিয়ে সর্বশান্ত পর্যন্ত হয়ে পড়ে্ন। কেন এমন হয় আর কেনই বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বেশীর ভাগের রিটার্ণ এত কম হয় সেটা রীতিমত গবেষণার বিষয় বৈকি। সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবে বিনিয়োগ বোদ্ধাদের অধিকাংশের মতে সেরুপ অবস্থার মূল কারণ বিনিয়োগকারীদের নিজ অভ্যাসজাত ও অজ্ঞানতাপ্রসূত কিছু ভুল। সে সংক্রান্ত কিছু ভুল তুলে ধরে সাধারন বিনিয়োগকারীদেরকে সংশোধনে সাহায্য করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য। সাধারনত বিনিয়োগকারীরা যেসব ভুল বেশী করেন তাহলোঃ

(১) বিনিয়োগ স্ট্র্যাটেজী না থাকাঃ অধিকাংশ সাধারন বিনিয়োগকারী সুনির্দিষ্ট বিনিয়োগ স্ট্র্যাটেজী অনুসরন করেন না। সেরুপ স্ট্র্যাটেজীতে এ্যাসেট এলোকেশন (মোট মূল্ধনের কতটুকু কোন সেক্টরে বিনিয়োগ হবে), বাই স্ট্র্যাটেজী (কোন ক্রাইটেরিয়া পূরণ হলে বিশেষ কোম্পানীর শেয়ার কেনা হবে), এক্সিট স্ট্র্যাটেজী (কি ক্রাইটেরিয়া পূরণ হলে বিক্রি হবে) অন্তর্ভূক্ত থাকে। এরুপ স্ট্র্যাটেজী থাকলে ক্রয় বিক্রয়ে বিনিয়োগকারী নিজস্ব আবেগের প্রভাব থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকেন যার ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অথচ আমাদের দেশে সাধারন বিনিয়োগকারী সে বিষয়ে তেমন সচেতন নয়।

(২) স্টাডি না করে শেয়ার ক্রয়ঃ কোম্পানী সম্বন্ধে ভাল্ভাবে না জেনে অন্যের পরামর্শে শেয়ার কেনাই বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বড় ভূল। আর্থিক প্রতিবেদন পড়ে তা যাচাই বাছাই করে কোম্পানীর সবল ও দুর্বল দিকগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। কোম্পানীর ব্যবসা কেমন, কিসের ব্যবসা করে, বাজারে প্রতিযোগী কোন কোন কোম্পানী রয়েছে, ম্যানেজমেন্ট কেমন, আয়ের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিনা ও হলে তা কেমন, শেয়ারের দাম কেন বাড়ছে, ভবিষ্যত ব্যবসা কেমন হতে পারে সেসব নানা তথ্য জেনেই তারপর বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। কোন শেয়ার কেনার আগে তা কেন কেনা হবে সে প্রশ্ন নিজেকে করতে হবে এবং সম্ভব হলে প্রশ্নের উত্তর লিখে রাখতে হবে যাতে পরবর্তীতে তা মূল্যায়ন করা যায়। সাধারন বিনিয়োগকারীরা এ ভূল করলেও প্রাতিষ্ঠানিক বা অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা কিন্ত সব তথ্য ভাল্ভাবে যাচাই করেই তারপর শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।

(৩) স্টপ-লস না করাঃ নিজ পুঁজি রক্ষায় স্টপ-লস কার্যকরী করা একটি অতি আবশ্যকীয় স্ট্র্যাটেজী। যে কোন শেয়ারের দাম যে কোন সময় নানা কারণে কমে যেতে পারে। দাম কমে কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে তা কেউই সঠিকভাবে ধারণা করতে পারে না। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হলো ক্রয় দামের নীচে কোন পূর্বনির্ধারিত দামে আসার পরপরই কিছুটা লসে হলেও শেয়ার বিক্রি করে দেয়া। আরো বড় ধরণের লস থেকে নিজ পূঁজি রক্ষার স্বার্থেই তা করা দরকার। যদি তা না করে শেয়ারটির দাম কিছুদিনের মধ্যেই পূর্বের অবস্থায় ফিরবে ভেবে শেয়ারটি ধরে রাখা হয় তবে অনেক ক্ষেত্রেই দাম আরো পড়ে যায় এবং বিনিয়োগকারী তার পুঁজির বড় অংশই হারিয়ে ফেলেন। মনে রাখতে হবে যে একবার বড় ধরনের লস হয়ে গেলে শেয়ার মার্কেটে ঘুরে দাঁড়ানো সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ দাম কমে গেলে যে হারে পুঁজি হারায় পরবর্তীতে তা ফিরে পেতে অনেক বেশী হারে দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন হয়। যদি কোন শেয়ারের দাম ৫০% পড়ে যায় তবে পরে তার দাম ৫০% বাড়লেও আসল পুঁজি ফিরে আসবে না। ধরা যাক, ১০০ টাকা দামের কোন শেয়ারের দাম কমে ৫০ টাকা হলো। এখন ৫০ টাকার বর্তমান শেয়ার ধরে রাখা হলো এবং কিছুদিন পরে তার দাম ৫০% বাড়লো। ৫০ টাকার শেয়ারের উপর ৫০% বাড়ার পর তার দাম হবে মাত্র ৭৫ টাকা। তাই প্রকৃত পুঁজি ১০০ টাকা ফিরে পেতে ৫০ টাকা দামের শেয়ারটির ১০০% মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হবে। এসব কারণে স্টপ-লসের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি অনেকটা সম্পদের বীমা করার মত। দূর্ঘটনা থেকে সম্পদ রক্ষায় বীমা্র প্রিমিয়াম প্রদানের আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করা যেমন প্রয়োজন, ঠিক একইভাবে স্টক মার্কেটে নিজ পুঁজি রক্ষার্থে স্টপ-লস কার্যকরী করা আবশ্যক। কিন্ত দুঃখজনকভাবে এটা সত্যি যে অধিকাংশ সাধারন বিনিয়োগকারী স্টপ-লস কার্যকরী করেন না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে তাদের পুঁজি আটকে থাকে। স্টপ-লস কার্যকরী করা হলে একটা আইটেমে লস খেলেও অন্য আইটেমে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ পাওয়া যায় যা পুঁজি আটকে থাকলে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে দীর্ঘ সময় ধরে মন্দা অবস্থা চলাকালীন অধিকাংশ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সেরুপ অবস্থার স্বীকার হয়েছিল।

(৪) দাম বৃদ্ধির পর শেয়ার ক্রয়ঃ কোন শেয়ারের দাম অনির্দিষ্টকাল ধরে বাড়ে না। কয়েকদিন বৃদ্ধির পরে স্বাভাবিকভাবেই দামের কারেকশন হয় বা পূর্বের দামে তা ফিরে আসে। তাই দাম অনেকটা বৃদ্ধির পরে তা ক্রয় করা হলে লাভের সম্ভাবনা অনেকটা কমে যায়, এমনকি লসেরও আশংকা থেকে যায়। কিন্ত অধিকাংশ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী দাম অনেকটা বাড়ার পর সে শেয়ারটি কিনে থাকে। কোন শেয়ারের অতি সাম্প্রতিক ফান্ডামেন্টালস পরিবর্তনের খবর সঙ্গে সঙ্গেই যেহেতু সাধারন বিনিয়োগকারীরা জানতে পারেন না, সেহেতু তারা ঐ শেয়ারটি ক্রয়-বিক্রয় করে্ন বাজারে দামের প্রতিক্রয়া অনেকটা সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পরে। তাই হয়তো দেখা গেল তারা কেনার পরে শেয়ারটির দাম না বেড়ে বরং কমে গেল। আর কেনার পরপরই যেহেতু তা বিক্রি করা যায় না, সেহেতু অনেকক্ষেত্রেই মূল ক্ষতির স্বীকার হয়ে থাকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

(৫) লাভজনক শেয়ার আগে বিক্রি এবং অলাভজনক শেয়ার ধরে রাখাঃ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ যে শেয়ারে লাভ আছে তা আগে বিক্রি করে দেয় আর যেখানে লস হবে তা বিক্রি না করে ধরে রাখে। অলাভজনক শেয়ার ধরে রেখে অন্তত কেনা দাম আসা পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করে থাকে। যে কোন মূল্যে আর্থিক লস পরিহারের মানসিকতা থেকেই তাঁরা এরুপ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। অথচ সেটি একটি মারাত্মক ভূল স্ট্র্যাটেজী। কারণ যে শেয়ারটি বিক্রি করে দেয়া হলো তা হয়তো ভাল কোম্পানীর শেয়ার এবং সে কারণেই শেয়ারটির দাম আরো বৃদ্ধির সুযোগ ছিল। আর যেটার দাম কমলো তার নিশ্চয়ই কারণ আছে। হয়তো নিজস্ব কোন কারণেই কোম্পানীটি খারাপ সময় অতিক্রম করছে যা নিকট ভবিষ্যতে উত্তরণ সম্ভব নাও হতে পারে। ফলে ঐ শেয়ারটির দাম সহসাই বাড়বে না কিংবা বাড়লেও বিক্রি করে দেয়া ভাল কোম্পানীটির মত বাড়বে না। তাই লাভ থাকলেই ভাল কোম্পানীর শেয়ার বিক্রি করে অন্য শেয়ার রেখে দেয়াকে তুলনা করা যায় বেশী দুধ দেয়া গাভীটি বিক্রি করে সেই গাভী ধরে রাখা যে কিনা আদৌ দুধ দেয়না বা কম দুধ দেয়। এরুপ অভ্যাসের কারণে সাধারন বিনিয়োগকারীদের অনেকেই দীর্ঘদিন আটকে থাকে অলাভজনক শেয়ার পোর্টফলিওতে। তাই ভূল কোম্পানীতে বিনিয়োগ হয়ে গেলে ভূল স্বীকার করা এবং তা মেনে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হয়ে আসাই সঠিক বিনিয়োগ স্ট্র্যাটেজী। মার্কেটকে চ্যালেঞ্জ করে শেয়ার বাজারে টিকে থাকা যায় না। তাই মার্কেট ট্রেন্ডের সাথে থাকতে হবে এবং সে অনুযায়ী বিনিয়োগ স্ট্র্যাটেজী গ্রহণ করতে হবে। কিন্ত বাস্তবে অধিকাংশ সাধারন বিনিয়োগকারী তার উল্টোটাই করে থাকেন।

(৬) মার্কেট ট্রেন্ড না বুঝতে পারাঃ মার্কেট মূলত ৩টি ট্রেন্ডের হয়- আপ্ট্রেন্ড, ডাউনট্রেন্ড কিংবা সাইডওয়েজ (নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে ঘুরাফেরা করা)। মার্কেট ট্রেন্ডের ধারা সঠিকভাবে বুঝতে পারা বিনিয়োগকারীর লাভ-লসের গুরত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। বলা হয়ে থাকে যে ‘ট্রেন্ড ইজ ইওর ফ্রেন্ড’। ট্রেন্ড দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি ক্রয় না বিক্রয় করবেন। কিন্ত সমস্যাটা হলো যে মার্কেট ট্রেন্ড সঠিকভাবে বুঝতে পারাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ বিস্তর। তবে অনেক অভিজ্ঞজনেরা বলেন যে আপ্ট্রেন্ডের সময় যখন ট্রেড ভলিউম পূর্বের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায় অথচ ওভারঅল ইন্ডেক্স বাড়ছে না তখনই ধরে নিতে হবে যে মার্কেট পতনের সময় হয়েছে। আবার ডাউনট্রেন্ডের সময় ভলিউম বাড়বে কিন্ত ইন্ডেক্সের অধিকতর পতন হবে না এমন অবস্থা হলেই বুঝা যাবে ডাউনট্রেন্ড শেষ হয়েছে। যাহোক, সাধারন বিনিয়োগকারীদের উচিত হবে সূচক এবং ট্রেড ভলিউম কোন দিকে যাচ্ছে তার উপর বিশেষ নজর রাখা এবং মার্কেট ট্রেন্ডের গতি অনুধাবন করার চেষ্টা করে সে অনুযায়ী নিজের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেয়া, যা অধিকাংশ মানুষই সঠিকভাবে করতে পারেন না। এরুপ দূর্বলতার কারণেই দেখা যায় যে, দাম একটু বাড়লেই অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে বড় ধরনের লাভের সু্যোগ হারায়। আবার কখনো চড়া দামে শেয়ার কিনে ধরা খায়। মার্কেট ট্রেন্ড সঠিকভাবে বুঝতে না পারার ফলেই সে অবস্থা হয়ে থাকে।

(৭) ট্রেড ডায়েরী সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ না করাঃ প্রতিদিনের ট্রেড ট্রাঞ্জেকশনের তারিখ, কোম্পানী, ক্রয় বিক্রয়ের পরিমাণ ও দাম, লাভ-লোকসান ইত্যাদির বিস্তারিত তথ্য তথা ট্রেড ডায়েরী অনেকেই ঠিকমত সংরক্ষণ করেন না। আবার অনেকে তা লিখে রাখলেও পরবর্তীতে কেন লাভ বা লোকসান হলো তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে্ন না। ফলে একই ধরনের ভূল বারবার ঘটে যায়। এটা মূলত অভ্যাসগত বিষয় যা পরিবর্তন করা গেলে শেয়ার ট্রেডিংকে লাভজনক করা সম্ভব।

উপরে যেসব ভূলের তালিকা দেয়া হলো তা নিশ্চয়ই পরিপূর্ণ নয়। তার বাইরেও বিনিয়োগকারীরা নানা ভূল করে থাকেন। তবে সবার ভূলের মাত্রা একরকম নয়। সংগত কারণেই যে যত কম ভূল করবে তার লাভের মাত্রা তত বেশী হবে এবং লোকসানের পরিমাণ কম হবে। বাস্তবে সবাই ভূল করে। তবে নিজের ভূল হওয়ামাত্রই বুঝতে পারা এবং তা সংশোধনে সচেষ্ট হওয়ার প্রচেষ্টাই বেশি জরুরী। শেয়ার মার্কেটে টিকে থাকতে সেটার আবশ্যকতা খুব বেশী।

লেখক: শফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল)
Email: msislam201386@gmail.com