জবিতে দেশের একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের গুচ্ছ ভাস্কর্য
আপডেট: ২০১৫-১২-২০ ১৬:৫৯:০২
‘৭১ এর গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’ শীর্ষক দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ ধরে এনে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) ভেতরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার পর লাশের স্তুপ সাজিয়ে গণকবর দেওয়া হয়। সেই নারকীয় হত্যাজজ্ঞের স্মারক হিসেবে গণকবরের ওপরে এ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে।
ভাস্কর রাসা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা ও যুদ্ধের প্রস্তুতির চিত্র উপস্থাপন করেছেন এই ভাস্কর্যের মাধ্যেমে। ১৯৮৮ সালে এ ভাস্কর্যের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৯১ সালে। ২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করা হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে একটু এগিয়ে গেলে নতুন ভবনের সামনে চোখে পড়ে ভাস্কর্যটি। এই ভাস্কর্যের সামনে ও পেছনে দুটি অংশ রয়েছে। গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধ, তাই এতে কামার, কুমার, জেলে, তাঁতীসহ সব স্তরের মানুষের যুদ্ধকালীন সময়ের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।
ভাস্কর্যটি দুটি অংশে ভাগ করা হয়েছে। এক পাশে একাত্তরের গণহত্যা, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ভাস্কর্যের নিচে রয়েছে পানি, এটি দিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশ বোঝানো হয়েছে। পানির ভেতরে রয়েছে বাংলা বর্ণমালা, এটি দিয়ে ভাষার আন্দোলনের চেতনাকে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বোঝানো হয়েছে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সফলতায় বাংলার মানুষের মাঝে স্বাধীনতার ভাবনা আসে।
বাংলার মাটি, মানুষ আর ভাষা একাকার হয়ে আছে এ ভাস্কর্যে। এ ভাস্কর্যে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ও বেদনার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ২৫ মার্চের কালো রাতকে। এ অংশে দেখানো হয়েছে- এই রাতে ইয়াহিয়া খান মাতাল অবস্থায় আছেন, পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, গর্ভবতী মাকে অত্যাচার করে হত্যা করা হচ্ছে, লাশ ফেলা হচ্ছে যেখানে-সেখানে। ভাস্কর্যের অংশহিসেবে রয়েছে একটি পত্রশূন্য বৃক্ষ।
তার উপর একটি শকুন বসে আছে। এটি সে সময়ের শ্মশান হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতীক। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জ্বালাময়ী ভাষণে বলেছিলেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’। ভাস্কর্যটির অপর অংশে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। বাংলার কামার, কুমার, জেলে, কৃষিজীবী মানুষ, মোটকথা সর্বস্তরের মানুষ একত্রিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে লড়ছে।
যার যা কিছু আছে- দা, বটি, খুন্তি, কোচ, বর্শা, সবকিছু নিয়ে যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছেতারা। পরের অংশে সবাই আধুনিক অস্ত্র নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। যুদ্ধে নামার পরে যখন যোদ্ধারা বুঝতে পারে যে, পুরাতন পদ্ধতি দিয়ে তাদের সাথে পেরে ওঠা সম্ভব নয়, তখন সবাই প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে, যেখানে রয়েছে সব বয়সি নারী- পুরুষ।পরিপূর্ণ যুদ্ধের জন্য গেরিলা কৌশল, মাঝারিআকারের অস্ত্রের ব্যবহার শিখছে তারা।
ভাস্কর্যের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে প্রশিক্ষণ নেওয়া সাহসী এক কৃষকের ছেলে। তার চোখে যুদ্ধজয়ের নেশা। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে সবার চোখে প্রতিশোধ স্পৃহার ছাপ রয়েছে। ভাস্কর্যে সবার মাথা একটু সোজা, মুখ লাল বর্ণের। এর কারণ রাগ হলে কালো মানুষের চেহারাও লাল বর্ণ ধারণ করে। আবার অন্যদিকে গণহত্যার দৃশ্যের রং ধুসর, কারণ এটি আমাদের বেদনাদায়ক স্মৃতি।
বর্তমানে ভাস্কর্যটি বিশ্ববিদ্যলয়ের শোভাবর্ধনের অদ্বিতীয় শিল্পকর্ম। এর চারদিকে আছে অপরূপ সৌন্দর্যময় পানির ফোয়ারা। ফোয়ারা ছাড়লে নয়নভিরাম দৃশ্যের অবতারণা হয়। রাতের বেলায় রঙিন বাতির আলোয় এর রূপ যেন আরো মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা এবং নতুন প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের নির্মম অধ্যায় তুলে ধরার এ ভাস্কর্যটি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকলেও তা অসম্পূর্ণ রয়েছে।
ভার্স্কর রাশা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পাঁচটি ভাগে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। তা হলো- একাত্তরের গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, ঘাতক, মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ এবং বিজয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্যে দুটি তুলে ধরা হয়েছে।