বায়োচার ব্যবহারে বাঁচবে পরিবেশ, সুফল পাবেন কৃষক
জেলা প্রতিনিধি প্রকাশ: ২০২১-০২-০৯ ১৪:৪৪:১৪
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ব্যাপক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি জমির উর্বরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকেরা বায়োচার ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন
নওগাঁয় আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষকরা। পরিবেশ দূষণ রোধের পাশাপাশি কৃষি বন্ধু চুলার ব্যবহার দিনদিন বাড়ছে। এ চুলায় রান্নার পাশাপাশি উৎপাদিত বায়োচার জমিতে ব্যবহারের ফলে মাটির স্বাস্থ্যও রক্ষা হচ্ছে।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমিতে একবার বায়োচার ব্যবহার করলে শতাধিক বছর এর কার্যকারিতা থাকে। তাই কার্বন সমৃদ্ধ বায়েচার বা কার্বন সমৃদ্ধ জৈব সার ব্যবহারে কৃষকদের অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি জমির উর্বরতা ও ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলার মান্দা উপজেলার প্রায় পাঁচ শতাধিক কৃষক চলতি মৌসুমে ফুলকপি, বাধাকপি, সরিষা, গম, ধান, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ভুট্টাসহ নানা ফসলি জমিতে কার্বন সমৃদ্ধ বায়োচার বা কার্বন সমৃদ্ধ জৈব সার ব্যবহার করেছেন। প্রকল্পটি আইসিসিও এবং কার্ক ইন এক্টাই এর সহায়তায় বেসরকারি সংস্থা সিসিডিবি মাঠ পর্যায়ে ডিএইকে সঙ্গে নিয়ে বাস্তবায়ন করছে।
কৃষি বন্ধু চুলায় কাঠ বা গোবর ও বিভিন্ন ধরনের বায়োমাস বা কৃষি অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে বায়োচার পাওয়া যায় যা কার্বন সমৃদ্ধ। এই কার্বন সমৃদ্ধ বায়োচার জমিতে ব্যবহারে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় ও খরা প্রবণ এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে চাষাবাদ করা যায়। বায়োচার জমিতে ভারী ও বিষাক্ত ধাতুকে (হেভী মেটালকে) নিষ্কিয় করে রাখে।
ফলে উদ্ভিদের শিকড়ের সাহায্যে তা ফসল পর্যন্ত পৌঁছায় না ফলে পাওয়া যায় নিরাপদ ও বিষাক্ত ধাতু মুক্ত ফসল। এই চুলায় ৩০-৪০% জ্বালানি কম লাগে তাই বনজ সম্পদ রক্ষা পায়। একই সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
উপজেলার হাজী গোবিন্দপুর গ্রামের গৃহিনী আদুরী বেগম খাবার রান্নায় ভরসা করছেন কৃষি বন্ধু চুলায়। আর চুলা থেকে যে কয়লা উৎপাদন হয় তা থেকে তৈরি করেন বায়োচার। তার দাবি এসব বায়োচার ও কার্বন সমৃদ্ধ জৈব সার নিজের আলুর
ক্ষেতে এবং পানের বরজে ব্যবহার করে তিনি পেয়েছেন ভাল ফলন। তার বক্তব্য অনুযায়ী কৃষি বন্ধু চুলা থেকে যে বায়োচার পান তা ফসলে ব্যবহার করেন। এতে ফসলে পানি ও সার কম লাগে। ফসল অনেক তাড়াতাড়ি বড় হয়।
গৃহিনী আদুরী বেগমের দেখাদেখি এলাকার অনেকেই বিভিন্ন সবজি ও পেঁয়াজের ক্ষেতে ব্যবহার করছেন বায়োচার। ব্যবহারকারীরা বলছেন, বায়োচার ও কার্বন সমৃদ্ধ জৈব সার ব্যবহার করায় জমিতে সেচ ও রাসায়নিক সার কম দিতে হচ্ছে। জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফসলের উৎপাদন বাড়ে। তাই দিনদিন বায়োচার প্রযুক্তিতে বাড়ছে ফসলের চাষাবাদ।
একই এলাকার কৃষক ময়নুল ইসলাম জানান, জমিতে বায়োচার সমৃদ্ধ জৈব সার ব্যবহার করায় মরিচ গাছগুলো বেশ সতেজ ও গাঢ় সবুজ হয়েছে। ফুল ও মরিচ ধরেছে তাড়াতাড়ি ডগাও বেশ মোটা। আর প্রচলিত পদ্ধতিতে চাষের জমির মরিচ গাছ অনেকটা ফ্যাকাসে, ডগাও সরু, ফুল ধরেছে কম, এখনও মরিচ ধরেনি।
কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বায়োচার ব্যবহার করলে জমির মাটি ভাল থাকে, ফল ভাল হয়, গাছ তরতাজা থাকে।
সম্প্রতি মান্দা উপজেলার হাজী গোবিন্দপুর গ্রামের প্রদর্শনী প্লট ও কৃষি বন্ধু চুলায় বায়োচার উৎপাদন পরিদর্শন করেন নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামছুল ওয়াদুদ, অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (সম্প্রসারণ) গোলাম ফারুক হোসেন, মান্দা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শায়লা শারমিন সিসিডিবির বায়োচার প্রজেক্টের কৃষ্ণ কুমার সিংহ, মার্কেটিং অফিসার মালিহা আক্তার, সিপিআরপির সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার আওসার আল মামুন, ইয়ুথ প্রোগ্রামের প্রজেক্ট ম্যানেজার নুসরাম জাহান।
মান্দা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শায়লা শারমিন বলেন, জমিতে ৫% পর্যন্ত জৈব পদার্থ থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে আমাদের জমিতে অনেক কম পরিমাণ জৈব পদার্থ আছে। সেক্ষেত্রে আমরা কৃষি বন্ধু চুলায় উৎপাদিত বায়োচার বা কার্বন সমৃদ্ধ জৈব সার ব্যবহার করতে পারি। এতে কৃষকরা উপকৃত হবেন।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (সম্প্রসারণ) গোলাম ফারুক হোসেন বলেন, “বায়োচার একবার জমিতে ব্যবহার করলে শতশত বছর পর্যন্ত মাটিতে উপস্থিতি বজায় রাখতে সক্ষম। ফলে বাড়ে মাটির উর্বরতা।”
তাই রান্নার পাশাপাশি জমির গুণাগুণ ধরে রাখতে বায়োচার ব্যবহারের পরামর্শ দেন এই কৃষি কর্মকর্তা।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শামছুল ওয়াদুদ বলেন, “অধিকহারে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির জৈব পদার্থ কার্বন দিন দিন কমে যাচ্ছে। ক্রমশ হ্রাস পাওয়া মাটিতে পরপর কার্বন সমৃদ্ধ জৈব সার ব্যবহারে কার্বন বৃদ্ধি পাবে। এটির ব্যবহারে মাটির স্থায়ীত্বশীলতা ও স্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। ফলে কম রাসায়নিক সার ব্যবহার করেও কৃষকরা বাড়তি ফল লাভ করবে।”