১১ মাসে নির্যাতনের শিকার ৭১৭ শিশু, হত্যা ৫৪৭: আসক
নিজস্ব প্রতিবেদক আপডেট: ২০২১-১২-২০ ২০:০৮:৩৫
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর এই ১১ মাসে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৭১৭ শিশু। আর বিভিন্ন কারণে হত্যা করা হয়েছে ৫৪৭ শিশুকে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২১৯টি। ঘরে-বাইরে শিশুদের প্রতি নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে তাদের। শুধু তাই নয়, করোনাকালীন সময়ে স্কুল পড়ুয়া শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে থাকতে হচ্ছে অনলাইনে। এখানেও নানাভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিশুরা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবেদনের এসব তথ্য তুলে ধরে বিশিষ্টজনরা বলেন, যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ ও প্রতিকারে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।
সোমবার (২০ ডিসেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আসক আয়োজিত ‘শিশু যৌন শোষণ ও নির্যাতন প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ক’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এ চিত্র তুলে ধরা হয়। আসকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১১ মাসে যৌন নির্যাতনের শিকার ৭১৭ জন শিশুর মধ্যে ৬ বছরের নিচে শিশুর সংখ্যা ১৩৫, সাত থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ২৯২ এবং ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ২৯০।
এছাড়া হত্যাকাণ্ডের শিকার ৫৪৭ জন শিশুর মধ্যে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সীর সংখ্যা ২৯৪, ছয় বছর পর্যন্ত শিশুর সংখ্যা ১২৮ এবং ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ১২৫ শিশুকে হত্যা করা হয়। আসকের নির্বাহী পরিচালক গোলাম মনোয়ার কামালের সঞ্চালনায় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আয়োজক সংস্থার শিশু অধিকার ইউনিটের প্রোগ্রাম সমন্বয়ক অম্বিকা রায়।
তিনি জানান, ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৪৫০ জন নারী ও শিশু অনলাইনে নির্যাতনের শিকার হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনের সূত্র ধরে তিনি জানান, ২০১১ সালে ৩৫ জন, ২০১২ সালে ৫১ জন, ২০১৩ সালে সাত জন, ২০১৪ সালে ৯৮ জন, ২০১৫ সালে ১২ জন, ২০১৬ সালে ২৪ জন, ২০১৭ সালে ১৩ জন, ২০১৮ সালে ৪১ জন, ২০১৯ সালে ৪৭ জন, ২০২০ সালে (করোনাকালে) ৭১ জন ও ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৫১ জন নারী ও শিশু অনলাইনে নির্যাতনের শিকার হন।
২০২১ সালের ১১ মাসে ৫১টি ঘটনার মধ্যে ১৮ বছরের নিচে শিশু ২৪ জন, ১৮ বছরের বেশি ৭ জন এবং বয়স উল্লেখ নেই ২০ জনের। ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১২১ জন শিশু অনলাইনে নির্যাতনের শিকার হয়।
ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব স্থাপন ও কথোপকথনের মাধ্যমে ছবি, ভিডিও ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করে ব্লাকমেইল করা হয়েছে। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীর ব্যক্তিগত ছবি/ভিডিও ও অন্যান্য পরিচিত তথ্য প্রকাশ করে হয়রানি করা; নারীর আপত্তিকর ছবি বা আপত্তিকর ভাষায় মেসেজ পাঠিয়ে হয়রানি করা; নারীর আইডি হ্যাক করে আইডিতে থাকা ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করে ব্লাকমেইল করাও হয়। এদের মধ্যে ১৬ শতাংশ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ বছরের কম, ৫৮ শতাংশ ভুক্তভোগী ১৮ থেকে ২৪ বছর, ২০ শতাংশ ভুক্তভোগী ২৪ থেকে ৩০ বছর এবং ৬ শতাংশ ভুক্তভোগীর বয়স ৩০ বছরের বেশি।
তিনি জানান, নারীর জন্য নিরাপদ সাইবার স্পেস নিশ্চিতকরণে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন গত বছরের ১৬ নভেম্বর গঠিত হয়। এক বছরে অর্থাৎ চলতি বছরের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত এক লাখ সাত হাজার ৭৭০ জন সেবা প্রত্যাশী এতে যোগাযোগ করেছিলেন। সাইবার স্পেসে হয়রানির সমাধান পেতে যোগাযোগ করেছেন ১২ হাজার ৯৪১ জন ভুক্তভোগী নারী। প্রযুক্তিগত এবং আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা দেওয়া হয়েছে ৮ হাজার ৩৩১ জনকে।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য অ্যারোমা দত্ত বলেন, করোনাকালীন সময়ে যৌন নির্যাতনের প্রকোপতা বেড়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টির গভীরতা বিবেচনায় নিয়ে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে সকল পর্যায়ে কাজ করা জরুরি। নতুন প্রজন্ম যেভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বাভাবিক নিয়মে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনে এগোতে চায়, সেভাবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও আমাদের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে। সেই লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, এটুআই, ডাক, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়-সকলের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সংসদ সদস্যরা এ বিষয় সম্পর্কে কতটুকু সচেতন এবং কিভাবে তারা এই সমস্যা প্রতিকারে কাজ করতে পারেন, তার জন্য আগামী ১০ বছরের একটি বিকল্প পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) প্রকল্প পরিচালক রায়হানা তাসলিম বলেন, শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবক এবং শিক্ষকদের জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম করা প্রয়োজন। শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে মোবাইল ফোনের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুইটি দিক সম্পর্কে আলোকপাত করা জরুরি।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন অ্যান্ড রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) উপপরিচালক জিয়ান শাহ কবির জানান, অনলাইনে শিশু নির্যাতন একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা প্রতিরোধে বাংলাদেশের সার্ভার ব্যবহার করে যে সকল নির্যাতনকারী যৌন নির্যাতন করছে তা বন্ধ করতে বিটিআরসি সক্ষম। অপরদিকে দেশের বাইরে সার্ভারে কোনো সাইট বন্ধ করতে হলে ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড’ বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন সাইট বন্ধ করার জন্য উদ্যোগ নিতে পারে।
এ সময় কভিড ১৯ শিশু কিশোরদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তাই অনলাইন মাধ্যমে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য সরকারি বেসরকারি সংস্থাসমূহের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি বলে অভিমত প্রদান করেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) শিক্ষাক্রম কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ শাহান আরা হুদা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহীন ইসলাম বলেন, শিশুর স্বাভাবিক শৈশব ফিরিয়ে দিতে পরিবেশের পাশাপাশি আচরণগত পরিবর্তনে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।
সমাপনী বক্তব্যে গোলাম মনোয়ার কামাল অনলাইনে যৌন হয়রানি থেকে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিতে কার্যকর ভূমিকা পালনের জন্যে সকলের সম্মিলিত প্রয়াসের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
এএ