প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণে কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২২-০১-১১ ২১:১৪:৩২


আত্মীয়-স্বজনের চেয়ে প্রতিবেশীই মানুষের সবচেয়ে আপন। কারণ আত্মীয়-স্বজন কখনও প্রতিবেশীর চেয়ে বেশি উপকারে আসে না। সুখে-দুঃখে কিংবা বিপদে-আপদে একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে প্রতিবেশী। এ কারণেই প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ করতে জোর দিকনির্দেশনা দেয় ইসলাম। কোরআন-সুন্নায় ওঠে এসেছে অনেক দিকনির্দেশনা। কী সেগুলো?

প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণের ব্যাপারে কুরআনে পাকে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

‘কাছের প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী এবং সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার কর।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৩৬)

হাদিসের প্রতিবেশীর অধিকার

প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্থ রেখে তৃপ্তি সহকারে আহার করতেও নিষেধ করা হয়েছে। হাদিসে পাকে এসেছে-হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ইবনুয যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে অবহিত করে বলেন, আমি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে তৃপ্তি সহকারে আহার করে সে মুমিন নয়।’ ( আদাবুল মুফরাদ, বাযযার, মস্তাদরেকে হাকেম, তাহাবি)

১. প্রতিবেশী মর্যাদা ওয়ারিশের কাছাকাছি

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, জিবরাঈল (আবু দাউদ) আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে এতো অধিক নসিহত করতে থাকেন যে, আমি মনে মনে ভাবলাম, তিনি হয়তো প্রতিবেশীকে ওয়ারিস বানাবেন।’ (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, হিব্বান)

২. প্রতিবেশীর প্রতি দয়া

হজরত আবু শুরায়হ আল-খুযাঈ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীর প্রতি দয়াপরবশ হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে সেন তার মেহমানের সমাদর করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন উত্তম কথা বলে অন্যথায় নীরব থাকে।’ (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ)

৩. প্রতিবেশীর মর্যাদা ১০গুণ বেশি

হজরত মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবিগণকে জেনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বলেন- ‘হারাম’; আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তা হারাম করেছেন। তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির দশটি নারীর সাথে জেনায় লিপ্ত হওয়া তার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে তার জেনা করার চেয়ে হালকা (পাপ)। পুনরায় তিনি তাদেরকে চুরি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন- তারা বলেন, ‘হারাম’; মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তা হারাম করেছেন। তিনি বলেন, কোন ব্যক্তির দশ পরিবারে চুরি করা আর তার প্রতিবেশীর ঘরে চুরি করার চেয়ে হালকা (অপরাধ)। (আবু দাউদ)

৪. প্রতিবেশী অমুসলিম হলে

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, তার জন্য একটি ছাগল জবেহ করা হলে তিনি তার গোলামকে বলতে লাগলেন, তুমি কি আমাদের ইয়াহুদি প্রতিবেশীকে তা দিয়েছো? তুমি কি আমাদের ইয়াহুদি প্রতিবেশীকে তা দিয়েছো? আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি- জিবরাঈল (আবু দাউদ) আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে অবিরত নসিহত করতে থাকেন। আমি মনে মনে ভাবলাম যে, তিনি তাকে হয়তো ওয়ারিস বানাবেন।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)

৫. প্রতিবেশীকে উপহার

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার দুইজন প্রতিবেশী আছে। তাদের মধ্যে কোন প্রতিবেশীকে আমি উপহার দেবো? তিনি বলেন, যার (ঘরের) দরজা তোমার অধিকতর নিকটবর্তী তাকে।’ (বুখারি, আবু দাউদ)

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নিকটবর্তী প্রতিবেশীকে বাদ দিয়ে দূরের প্রতিবেশী থেকে (উপহার দেওয়া) শুরু করা যাবে না, বরং দূরবর্তী জনের আগে নিকটবর্তী জন থেকে তা শুরু করতে হবে।’ (আদাবুল মুফরাদ)

৬. প্রতিবেশী কারা?

হজরত হাসান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, তাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, নিজের ঘর থেকে সামনের চল্লিশ ঘর, পেছনের চল্লিশ ঘর, ডানের চল্লিশ ঘর এবং বামের চল্লিশ ঘর তোমাদের প্রতিবেশী।’ (আদাবুল মুফরাদ)

৭. প্রতিবেশীর জন্য ঘরের দরজা উন্মুক্ত রাখা

হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আহু বলেন, এমন একটি কাল (সময়) আমরা অতিবাহিত করেছি যখন কারো কাছে তার মুসলিম ভাইয়ের চেয়ে তার দিনার ও দিরহামের উপযুক্ত প্রাপক আর কেউ ছিলো না। আর এখন এমন যুগ এসেছে যখন দিনার ও দিরহামই আমাদের কারো কাছে তার মুসলিম ভাইয়ের চেয়ে অধিক প্রিয়। আমি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, অনেক প্রতিবেশী কেয়ামতের দিন তার প্রতিবেশীকে অভিযুক্ত করবে এবং বলবে- এই ব্যক্তি আমার জন্য তার দ্বার রুদ্ধ করে রেখেছিল এবং আমাকে তার সদাচার থেকে বঞ্চিত করেছে।’ (আদাবুল মুফরাদ)

৮. প্রতিবেশকে ক্ষুধার্থ রেখে আহারের পরিণতি

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু সাহাবি ইবনে যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে অবহিত করে বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে অভুক্ত (ক্ষুধার্থ) রেখে তৃপ্তি সহকারে আহার করে; সে মুমিন নয়।’ (আদাবুল মুফরাদ, বাযযার, মুস্তাদরাকে হাকেম)

৯. খাবারে প্রতিবেশী হক

হজরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে তিনটি উপদেশ দিয়েছেন-

> নেতা নাক-কান কাটা গোলাম হলেও আমি তার নির্দেশ শুনবো এবং আনুগত্য করবো।

> তুমি তরকারি রান্না করলে তাতে বেশি ঝোল রাখবে; এরপর তোমার প্রতিবেশীদের দিকে লক্ষ্য করবে এবং সদিচ্ছা সহকারে তাদের তা পৌঁছাবে।

> নামাজ তার নির্ধারিত ওয়াক্তে আদায় করবে। যদি দেখো যে, ইমাম নামাজ পড়েছেন এবং তোমার নামাজও তুমি পড়েছো, তাহলে তোমার নামাজ তো হয়েছে নতুবা ইমামের সাথে তোমার নামাজ নফল হিসেবে গণ্য হবে।’ (আদাবুল মুফরাদ, মুসলিম, তিরমিজি, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ, ইবনে হিব্বান)

হজরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘হে আবু যার! তুমি তরকারি রান্না করলে তাতে পানি (ঝোল) বেশি রাখো এবং তা তোমার প্রতিবেশীদের মধ্যে বিলাও।’ (আদাবুল মুফরাদ, মুসলিম, আবু দাউদ, দারেমি, ইবনে হিব্বান)

১০. সর্বোত্তম প্রতিবেশী

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর কাছে সেই সঙ্গী উত্তম যে নিজ সঙ্গীদের কাছে উত্তম। আল্লাহর কাছে সেই প্রতিবেশী উত্তম যে নিজ প্রতিবেশীদের কাছে উত্তম।’ (তিরমিজি, আদাবুল মুফরাদ, আবু দাউদ)

১১. সৌভাগ্যের নিদর্শন প্রতিবেশী

হজরত নাফে ইবনুল হারিস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, একজন মুসলিমের জন্য প্রশস্ত বাসভবন, সৎ প্রতিবেশী ও আরামদায়ক বাহন সৌভাগ্যের নিদর্শন।’ (আবু দাউদ, মুস্তাদরেকে হাকেম, আদাবুল মুফরাদ)

১২. নিকৃষ্ট প্রতিবেশী

হজরত আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি তার প্রতিবেশী, তার ভাই এবং তার বাবাকে হত্যা না করা পর্যন্ত কেয়ামত হবে না।’ (আদাবুল মুফরাদ)

১৩. প্রতিবেশী জান্নাতি ও জাহান্নামি হওয়ার কারণ

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হলো- ইয়া রাসুলাল্লাহ! অমুক নারী সারা রাত নামাজ পড়ে; সারা দিন রোজা রাখে; ভালো কাজ করে; দান-সাদকা করে আর নিজ প্রতিবেশীদেরকে মুখের কথায় কষ্ট দেয়।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই, সে জাহান্নামি। পুনরায় সাহাবিগণ বলেন, অমুক নারী ফরজ নামায পড়ে, বস্ত্র দান করে এবং কাউকে কষ্ট দেয় না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সে জান্নাতি।’ (আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, মুস্তাদরেকে হাকেম, ইবনে হিব্বান, মুসনাদে বাযযার ও আদাবুল মুফরাদ)

১৪. নিকৃষ্ট প্রতিবেশী থেকে বেঁচে থাকার দোয়া

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি দোয়া-

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ جَارِ السُّوءِ فِي دَارِ الْمُقَامِ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন ঝারিস সুয়ি ফি দারিল মুকামি।’

অর্থ : হে আল্লাহ! আমি (আমার ) আবাসস্থলে তোমার কাছে দুষ্ট প্রতিবেশী থেকে আশ্রয় চাই।’

কেননা দুনিয়ার প্রতিবেশী তো বদল হতে থাকে।’ (নাসাঈ, মুস্তাদরেকে হাকেম, আদাবুল মুফরাদ, ইবনে হিব্বান)

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, প্রতিবেশীর অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রাখা। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করা। প্রতিবেশীকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া। দুষ্টু প্রতিবেশী থেকে আত্মরক্ষায় আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। প্রতিবেশী অমুসলিম হলেও তার প্রতি সদাচরণ করা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে প্রতিবেশীর হক আদায় করতে কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। প্রতিবেশীর অধিকারের প্রতি যত্নবান হওয়ার মাধ্যমে জান্নাতের অধিকারী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

সানবিডি/এনজে