ঢাকায় জরুরি অবস্থা জারির পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশ: ২০২২-০১-২৭ ১৬:৫২:৩৯


চলতি মাসে ঢাকার লোকজনের একদিনও ভালো বায়ু সেবনের সৌভাগ্য হয়নি। এই সময়ে বায়ুমান ‘অস্বাস্থ্যকর‘ থেকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর‘ অবস্থায় ছিলো। জানুয়ারিতে এখন পর্যন্ত গড় হিসাবে বায়ুমান সূচক ছিলো ২১৯.৫২। যা জরুরি অবস্থা জারির পর্যায়ে।

এমন পরিস্থিতি টানা ৩ দিন থাকলে বিশ্বের যে কোনো দেশ স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করে। অথচ টানা ২৫ দিন এই অবস্থা থাকলেও নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। এর প্রেক্ষিতে দ্রুত বায়ু দূষণের ক্ষতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারির পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।

বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়রি) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের ঢাকায় বিপজ্জনক মাত্রায় ঢাকার বায়ুদূষণ: জনস্বাস্থ্য ও দুর্যোগ মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন সংগঠনটি। বায়ুদূষণ মোকাবিলায় ১৫ দফা দাবিও পেশ করে।

সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ণ কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর পরিচালক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার জানান, ২০১৬-২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বায়ুমান সূচক (একিউআই)-এর তথ্য বলছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে গড় বায়ু দূষণ বেড়েছে ৯.৮ শতাংশ। ২০২২ সালে জানুয়ারিতে গড় বায়ুমান সূচক ২১৯.৫২ এ দাঁড়িয়েছে। যা খুবই অস্বাস্থ্যকর।

ঢাকার ১০টি স্থানের গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ২০২১ সালে ঢাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত ছিলো তেজগাঁও এলাকা (প্রতি ঘনমিটারে ৭০ মাইক্রোগ্রাম)। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলো শাহবাগ এলাকা (প্রতি ঘনমিটারে ৬৮ মাইক্রোগ্রাম)। প্রত্যকটি স্থানের গড় বস্তুকণা ছিলো ২.৫। যা মান মাত্রার কয়েক গুণ বেশি।

গবেষণা অনুযায়ী, আহসান মঞ্জিল, আবদুল্লাহপুর, মতিঝিল, ধানমন্ডি-৩২, সংসদ ভবন, আগারগাঁও, মিরপুর-১০ এবং গুলশান-২ এ গড় বস্তুকণা ছিলো ২.৫। প্রতি ঘনমিটারে যথাক্রমে ৫৭, ৬২, ৬০, ৬৩, ৫৯, ৬১, ৬৬ ও ৬৫ মাইক্রোগ্রাম। যা নির্ধারিত মান মাত্রার প্রায় ৪-৫ গুণ বেশি।

তিনি জানান, দৈনিক ২৪ ঘণ্টা ভিত্তিতে রাজধানীর বায়ু দূষণের মান সবচেয়ে খারাপ অবাস্থানে থাকে রাতে। বিকাল ৪টার পর থেকে বায়ু দূষণের মান খারাপ হতে শুরু করে যা রাত ১১ টা থেকে ২টার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছায়।

এই পরিস্থিতির জন্য নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দূর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা ও সর্বোপরি সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ ও জনসচেতনতার ঘাটতিকেই দায়ী করেন অধ্যাপক ড. কামরুজ্জমান।

সংবাদ সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে বাপা‘র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, নগরের বায়ুর মান ক্রমান্বয়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে যাওয়ার পরও নাগরিকদের অবগত না করায় সরকারের বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিনি অবিলম্বে সরকারকে ঢাকার বায়ু সম্পর্কে যথাযথ তথ্য দেওয়ার দাবি জানান। জীবন হুমকির মুখে ফেলা উন্নয়ন চান না বলেও উল্লেখ করেন।

বাপা‘র নির্বাহী কমিটির সদস্য এম এস সিদ্দিকী বলেন, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজের ফলে ঢাকার দূষণ বেশি হচ্ছে। এই দূষণ কমাতে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহারের পরামর্শ দেন তিনি। সরকার পরিকল্পনা ও বাজেট যথাযথ ব্যয় করলে নির্মাণ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

গত এক দশকে ব্যবহৃত মোবাইল ও ইলেক্ট্রনিকস সামগ্রীর ব্যাটারি কীভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয় ও সেগুলো থেকে কী পরিমাণ দূষণ হয় তার সঠিক হিসাব বের করতে সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোকে অনুরোধ জানান বাপা‘র নির্বাহী কমিটির সদস্য ইবনুল সাঈদ রানা।

ক্যাপসের গবেষণা শাখার প্রধান আব্দুল্লাহ আল নাঈম বলেন, ধূলা দূষণের পাশাপাশি নগরীর গ্যাসীয় দূষণ ও বাতাসে সীসা দূষণের পরিমাণও বেড়ে চলেছে। সীসা দূষণের অন্যতম উৎস যেমন- ব্যাটারি ও সালফার যুক্ত গ্যাসোলিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। যুব বাপা‘র সদস্য সচিব রাওমান স্মিতা, দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ও জনগণকে শক্তিশালী ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।

সংবাদ সম্মেলনে বায়ু দূষণের ভয়াবহতা থেকে উত্তরণের জন্য ১৫ টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়-

স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপঃ

১. শুষ্ক মৌসুমে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা ও পরিবেশ অধিদপ্তর-এর সমন্বয়ে ঢাকায় প্রতিদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

২. নির্মাণাধীন স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখতে হবে ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নিতে হবে।

৩. রাস্তায় ধূলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪. অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়াতে হবে।

৫. ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেস বিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা যেতে পারে।

মধ্যমেয়াদী পদক্ষেপঃ

৬. সরকারি ও বেসরকারি উদ্দ্যোগে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে ও ছাদ বাগান করার জন্য সকলকে উৎসাহিত করতে হবে।

৭. ঢাকার আশেপাশে জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে।

৮. আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করতে হবে।

৯. আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসেবে সেন্ড বক্ল-এর ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে।

১০. সিটি গভর্নেন্স-এর প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়ন মূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করতে হবে। সেবা সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপঃ

১১. নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ যতদ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে।

১২. পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষন স্টেশন (ক্যামস)-এর ব্যাপ্তি বাড়িয়ে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে আওতাধীন করতে হবে। বায়ু দূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করতে হবে।

১৩. সর্বোপরি সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে বায়ু দূষণ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য নির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ু দূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

১৪. ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।

১৫. পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকর করতে হবে।

এএ