নিজেদের কর্মীকে শিবির আখ্যা দিয়ে ছাত্রলীগের নেতাদের নির্যাতন

প্রকাশ: ২০১৬-০২-২০ ১২:০৬:২৬


Chhatro Leageঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় (আইবি) বিভাগের শিক্ষার্থী মো. হোসাইন মিয়া ইসলামী ছাত্রশিবির নয়, ছাত্রলীগের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। তাঁকে ছাত্রলীগ থেকে সরাতে নিজ সংগঠনের হল শাখার নেতারাই ‘শিবির কর্মী’ আখ্যা দিয়ে বর্বর নির্যাতনের পর পুলিশে সোপর্দ করেছিলেন।

বিজয় একাত্তর হলে হোসাইনকে নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে ওই ঘটনায় হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ছয়জনকে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। হোসাইনসহ তিন ছাত্রকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে গত বছরের ২ আগস্ট রাতে। নির্যাতিত অপর দুজন হলেন উর্দু বিভাগের এনায়েতউল্লাহ এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মানিক হোসেন। নির্যাতনের পর হোসাইন ও মানিককে ‘শিবির কর্মী’ আখ্যা দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন হল শাখার নেতারা।

‘গেস্টরুম’-এর নামে হলে নবীন শিক্ষার্থীদের মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি ছাত্রলীগ না করলে হলে থাকতে না দেওয়ার অভিযোগ ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ই পাওয়া গেছে। এবার নিজ সংগঠনের কর্মীকে ‘শিবির কর্মী’ আখ্যা দিয়ে নির্যাতন করে হল থেকে বের করে দেওয়ার প্রমাণ মিলল এই তদন্ত প্রতিবেদনে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনার রাতে (২ আগস্ট, ২০১৫) বিজয় একাত্তর হলের পদ্মা ব্লকের ৮০০১ নম্বর কক্ষে তিনজন ছাত্রকে (হোসাইন, এনায়েত ও মানিক) হাত বেঁধে, মুখে গামছা ঢুকিয়ে, পেছন থেকে মুখ চেপে ধরে ক্রিকেটের ব্যাট দিয়ে একের পর এক আঘাত করা হয়। চিৎকার যাতে বাইরে যেতে না পারে, সে জন্য নির্যাতনকারীদের একজন চেয়ারের পেছন থেকে মুখে গামছা চেপে ধরে রাখেন। হোসাইনকে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করা হয়। হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবেই দুবার তাঁর নাক-মুখ চেপে প্রায় শ্বাসরোধ করে ফেলার উপক্রম করা হয়। এর ফলে এমনকি তাঁর মৃত্যুও ঘটতে পারত।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সিসিটিভি ফুটেজ, অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বক্তব্য এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী তদন্ত কমিটি জানতে পেরেছে, রাত ১২টা ৫৭ মিনিটে মানিককে ধরে লিফটে করে ওপরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি (শেখ ওয়ালী আসিফ ওরফে ইনান) ও সাধারণ সম্পাদক (ফুয়াদ হোসাইন ওরফে শাহাদাৎ) ছাড়াও আরও দুজন ছিলেন। রাত সাড়ে তিনটায় মানিক ও হোসাইনকে একই লিফটে নামিয়ে এনে হল ফটকের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তাঁরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। এই দুজনকে প্রক্টরিয়াল টিমের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া হোসাইনের রুমমেট এনায়েতকে মারধরের পর ভয় দেখিয়ে হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

বিজয় একাত্তর হলে হোসাইন মিয়াকে নির্যাতনের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন তদন্ত কমিটি বলেছে, ‘সন্দেহাতীতভাবে প্রতীয়মান হয় যে ওই রাতে শাহাদাতের নির্দেশে ও পরিচালনায় তাঁরই কক্ষে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী তিনজন ছাত্রের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। শাহাদাৎ নিজে ওই ছাত্রদের চড়-থাপ্পড় ও ঘুষি মারেন এবং একপর্যায়ে ব্যাট দিয়ে আঘাত করেন। তবে ব্যাট হাতে বেশির ভাগ সময় নির্যাতন চালান ইতিহাস বিভাগের তৌকির হোসেন। নির্যাতনকালে পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের মো. নেয়ামতউল্লাহ, অর্থনীতি বিভাগের মেহেদি হাসান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মেহরাব হোসেন নির্যাতিতদের মুখ ও পা চেপে ধরে রাখেন। শেখ ইনান বিভিন্ন সময় নির্যাতনকারীদের নির্দেশনা দিলেও কাউকে সরাসরি আঘাত করেননি বলে প্রতীয়মান হয়। বরং অভিযোগকারীরা উল্লেখ করেছেন, বিভিন্ন সময় তিনি নির্যাতিতদের প্রতি সহানুভূতি দেখান।’
গত ৩ আগস্ট হোসাইন আদালত থেকে ছাড়া পান। পরদিন তিনি নির্যাতনের বিষয়ে উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৪ আগস্ট বিজয় একাত্তর হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক রবিউল হককে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। এই কমিটি তদন্ত শেষে সম্প্রতি উপাচার্যের নেতৃত্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির (ডিবি) কাছে প্রতিবেদনটি বিবেচনার জন্য দিয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ ইনান দাবি করেন, ওই নির্যাতন সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। আর সাধারণ সম্পাদক ফুয়াদ হোসাইন বলেন, ‘তাঁরা (হোসাইনসহ তিনজন) শিবির করতেন। তাঁদের জবানবন্দির তথ্য অনুযায়ী আরও অনেক শিবির খুঁজে বের করা হয়েছে। এখন হঠাৎ করে এ ধরনের একটা তদন্ত প্রতিবেদন হতে পারে না। যদি হয়, তবে শুধু অভিযোগকারীর বক্তব্যকেই আমলে নেওয়া হয়েছে। আর হল প্রশাসন কিছুদিন ধরে আমাদের অন্যভাবে দেখছেন। জানি না বিষয়টা কী। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগ একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’
শৃঙ্খলা কমিটির সদস্যসচিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক এম আমজাদ আলী এই প্রতিবেদন জমা হওয়ার বিষয়টি গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, প্রতিবেদনটি উপাচার্যের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে বৈঠকে উত্থাপনের জন্য এখনো তাঁর কাছে পাঠানো হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবেদন জমা দিয়ে থাকলে পাব।’
প্রতিবেদন দেওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে বিজয় একাত্তর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা তদন্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জমা দিয়েছি। সর্বশেষ অবস্থা জানি না। আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।’
হল সূত্র বলেছে, তৌকির, নেয়ামতউল্লাহ, মেহেদি ও মেহরাব হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মী। তদন্ত প্রতিবেদনে ওই ছয়জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি হলের ফটকে দায়িত্বরত কর্মচারী আতাউর ও প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার কথা বলা হয়েছে। কমিটি মনে করে, ‘এই পুরো ঘটনাটি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছে এবং এর সঙ্গে উল্লিখিত ছয়জন ছাত্রই কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিল।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘হোসাইন মিয়ার সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের কোনো ধরনের সংযুক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে, প্রথমে মানিককে অত্যাচার করে এমন একজন ছাত্রের (এনায়েতউল্লাহ) বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়, যিনি হোসাইনের কক্ষে থাকেন। পরে এনায়েতকে অত্যাচার করে হোসাইনের বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়। তদন্ত কমিটি মনে করে, পুরো ঘটনাটি সাজানো হয়েছে মূলত হোসাইনকে শিবির কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করে হল থেকে তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি থেকে বের করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। মানিক ও এনায়েত শুধু ঘটনার শিকার বলেই প্রতীয়মান হয়।’
হোসাইন বলেছেন, তিনি প্রথমে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে। ওই হল শাখা ছাত্রলীগে পদ না পেয়ে নবনির্মিত বিজয় একাত্তর হলের আবাসিক ছাত্র হন। ওই হল শাখায়ও পদ না পেয়ে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিতে পদ পেতে কাজ শুরু করেন। তাঁর এই ‘ডিঙ্গাতে চাওয়ার’ কারণে ক্ষুব্ধ হন হল শাখার নেতারা। এ কারণেই তাঁকে ও অপর দুই ছাত্রকে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। তদন্ত কমিটিকে দেওয়া এনায়েতের বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁকে দিয়ে হোসাইনের নাম বলানো হয় এবং তাঁকে হল ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়। ওই দিন তাঁর কক্ষে অবস্থান করা তাঁর ১০ বছর বয়সী ছোট ভাইকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত আটকে রাখা হয়।
সানবিডি/ঢাকা/এসএস