নওগাঁ’র ঐতিহ্যবাহী জবই বিল, পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা!!
আপডেট: ২০১৬-০২-২৩ ২১:০২:৩৪
নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী জবই বিলকে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা, মৎস্য সম্পদের সমাহার এবং কৃষি উৎপাদনশীল এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রায় ৪২ কোটি টাকা ব্যায়ে কয়েকটি প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে। এই প্রকল্পগুলো এখন একনেকে’র অনুমোদন হওয়া অপেক্ষায় রয়েছে। প্রকল্পগুলো একনেকের অনুমোদন লাভ করলে বিলসহ এর চারপাশে বসবাসকারী বাসিন্দাদের জীবন যাত্রার মান উন্নতসহ এলাকার চিত্র পাল্টে যাবে বলে স্থানীয় সচেতন মহল মনে করেন।
সাপাহার উপজেলার মানুষের বিনোদনে তেমন কোন জায়গা না থাকায় এখানকার মানুষ জবই বিলের বিশাল রুপালী জলরাশি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বিশেষ দুই ঈদে সময় কাটাতে তাঁরা এই বিলে গিয়ে নৌকা বাইচ দেখে আনন্দ উল্লাস করে থাকেন। বৃহৎ এই প্রকল্পটি পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়িত হলে এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র অতিথিশালা, বিলের জলের উপর ভ্রমনের জন্য স্পীডবোর্টসহ শিশু কিশোরদের আনন্দ বিনোদনের নানা ব্যাবস্থা থাকবে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, জবই বিলের উন্নয়ন, বিলের চারপাশের মৎস্যজীবিদের উন্নয়ন করে স্থানীয়ভাবে মাছের চাহিদা মিটিয়ে দেশের অন্যত্র মাছ রপ্তানী করার উদ্দেশ্যে বিল খননসহ বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হলে পরবর্তীতে সরকার ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে কয়েকটি প্রকল্প পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে পাশ করা হয়। বর্তমানে এই প্রকল্পগুলো প্ল্যানিং কমিশনে রয়েছে। তিনি আশা করেন অচিরেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বিলে প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নওগাঁ রিজিওন-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল মালেক চৌধুরী জানিয়েছেন বর্তমানে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিলের মধ্যে এল এল পি প্রকল্প গ্রহণ করে হাজার হাজার বিঘা কৃষি জমি সেচের আওতায় এনে পুরোদমে ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। এতে করে এলাকার কৃষকরা অতীতে সেচ কাজে যে খরচ হতো তার এক তৃতীয়াংশ অর্থ খরচ করেই তাদের উৎপাদিত ফসল ঘরে তুলতে পারছেন। এই কর্মসূচীর আওতায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এই বিলে ৮টি এল এল পি প্রকল্পে ৩২০ হেক্টর বিঘা জমিতে বোরো মওসুমে চাষাবাদ করেছেন। এ ছাড়া আরোও ৯টি প্রকল্পের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্ন কর্ত্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী মোঃ রেজাউল করিম জানিয়েছেন।
ঐতিহ্যবাহী এই বিলটি উত্তরে ভারতের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে বাংলাদেশের সাপাহার উপজেলাকে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে দক্ষিনে পুনর্ভবা নদীতে মিলিত হয়েছে। বিলটির প্রকৃত নাম হচ্ছে দামুর মাহিল বিল। জবই গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পরবর্তীতে মানুষের মুখে মুখে এই বিলের নামকরন হয়েছে জবই বিল। সরকারী রেকর্ড অনুযায়ী এই বিলের আয়তন প্রায় ১ হাজার একর। কিন্তু বর্ষকালে দু-কুল ছাপিয়ে এর আয়তন বৃদ্ধি পেয়ে হয় প্রায় ৩ হাজার একর। অতীতে বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক মাছে ভরা থাকত এই বিল। শীত কালে সুদুর সাইবেরীয়া থেকে অসংখ্য অতিথি পাখী আসত এখানে। রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থান হতে অনেক পাখী শিকারীরা এই বিলে আসতেন পাখী শিকার করতে। সে সময় সারা দেশের মত এ অঞ্চলের মানুষও ছিল মাছে-ভাতে বাঙালী।
১৯৮৬/৮৭ সাল থেকে সরকারী নীতিমালার আওতায় খাজনার মাধ্যমে এলাকার মৎস্যজীবিদের মাঝে ইজারা প্রদানের যে ব্যাবস্থা চালু ছিল পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এই নীতিমালকে পরিবর্তন করে জাল যার জলা তার নীতির ঘোষনা দেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন সরকারের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারী এক সফরে সাপাহারে এলে বিভিন্ন উন্নয়নের পাশাপাশি এলাকার মৎস্যজীবিদের ভাগ্যোন্নয়নে ৩ কোটি ৫৫ লক্ষ্য টাকা ব্যয়ে সরকারী ভাবে এই বিলটিকে একটি বৃহৎ মৎস্য প্রকল্প হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষনা দেন। এই প্রকল্পের আওতায় বিলের দু’পাশের লোকজনের যাতায়াত ব্যাবস্থাকে সহজতর করতে বাঁধ নির্মান, এক কিলোমিটার এপ্রোচ সড়ক এবং এই সড়কে ২শ’মিটার একটি সেতু নির্মান করা হয়। তারপর থেকেই এই বিলে মাছের উৎপাদন বেড়ে যায়। মওসুমে হাজার হাজার টন মাছ উৎপাদন করে বিল পাড়ের প্রায় সাড়ে ৮শ’ মৎস্যজীবিদের সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা।
বর্তমানে সাপাহার উপজেলার এই জবই বিলের মাছ সাড়াদেশ জুড়ে ব্যপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। এই বিলে সারা বছর প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হয় বিশালাকৃতির শোল, বোয়াল, আইড়, পাবদা, বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এসব মাছ নওগাঁ জেলার মানুষের চাহিদা মিটিয়েও ঢাকার কাওরান বাজার, টাউন হল মার্কেট সহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এই বিলের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির মাধ্যমে আকর্ষনীয় করে তুলতে গৃহিত ৪২ কোটি টাকার প্রকল্পে রয়েছে মূলত: একটি রেগুলেটর স্টীম (সুইচ) গেট, বিলের মুল জলাধারে পর্যাপ্ত পানি সংরক্ষন করে রাখার জন্য পুরো বিল এলাকায় খনন কাজ, বাঁধ নির্মান এবং প্রটেকশন ওয়াল নির্মান। ইতিপূর্বে বিলটিতে কখনও কোন খনন কাজ না হওয়ায় উজান থেকে ভারতের পলিমাটি ও পাড় এলাকার মাটি ধসে গিয়ে বিলটির এখন প্রায় ভরাট অবস্থা। সরকারের বৃহৎ এই প্রকল্পটি সুষ্ঠ ভাবে সমাপ্ত হলে পুরো বিল এলাকাটি একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত, বিল হতে সেচ কাজের মাধ্যমে ব্যপক ফসল উৎপাদনের কারনে এলাকায় সবুজের সমারোহ বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়াও বিল হতে লক্ষ লক্ষ টন মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে এলাকার সাধারণ মানুষ সহ মৎস্যজীবিগন মনে করেন। সে সাথে জবই বিল সহ বিল পাড়ের বাসিন্দাদের জীবন চক্রই পাল্টে যাবে। অপরদিকে উপজেলার কয়েকশত পরিবারের মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
সানবিডি/ঢাকা/রাআ