ফিরে দেখা-২০২২

নানা সংকট আর ঘটনার বছর

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশ: ২০২২-১২-২৯ ১৯:০৫:৫২


ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে করোনার মহামারিতে বিধ্বস্ত বিশ্ব যখন ধীরে ধীরে ছন্দে ফেরার প্রত্যাশা করছিল তখনি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সেই গতি মন্থর করে দেয়৷ ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত শুরুর পর থেকেই অস্থিরতা দেখা দেয় বিশ্বের পুঁজিবাজারে৷ দেশের পুঁজিবাজারও এ অবস্থা থেকে বাদ পড়েনি৷ বিভিন্ন কারণে বাজার-চিত্র পাল্টে যেতে থাকে৷ লেনদেন ও সূচক কমতে থাকে৷ টানা দরপতনে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে৷ বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পক্ষ হতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়৷ পুঁজিবাজারের চলমান দরপতনের সাথে যুক্ত হয় বিশ্ব অর্থনীতির নানামূখী সংকটের প্রভাব৷ বিশ্বজুড়ে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে বিপাকে পড়ে ছোট অর্থনীতির দেশগুলো৷ অর্থনীতিতে দেখা দেয় অস্থিরতা৷ বৈশ্বিক অর্থনীতির বৈরী পরিস্থিতির প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন আর্থিক সূচকেও নেতিবাচক ধারা পরিলক্ষিত হয়৷ এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিও অনেকটা চাপের মুখে পড়ে৷ নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানামুখী উদ্যোগে বছরের প্রথমভাগে (জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি) এবং শেষের দিকে আগষ্ট, সেপ্টেমবর এবং অক্টোবর মাসে পুঁজিবাজারে যে উত্থান দেখা দিয়েছিল, তার স্থায়িত্ব বজায় না থাকায় শেষ দুই মাসের অস্থিরতা নিয়েই শেষ হয়েছে ২০২২ সাল৷

তবে সদ্য বিদায়ী বছরে নানা সংকটের মধ্যেও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিয়েই এবারের সালতামামি৷  পুঁজিবাজারে প্রথমবারের মতো ইসলামি সুকুক বন্ড তালিকাভুক্তির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে সম্ভাবনার এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে৷ ৩,১৬৮,০৮০.২৯ মিলিয়ন টাকা বাজার মূলধন নিয়ে ডিএসই’র ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মে বহুল প্রতিক্ষিত ২৫০টি সরকারি সিকিউরিটিজের লেনদেন শুরু হয়েছে৷ পুঁজিবাজারে অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি)-এ লেনদেন শুরুর অপেক্ষায়৷ এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ) চালুর কার্যক্রমও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে৷ পুঁজিবাজারে রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট  (আরইআইট) প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ ওটিসি প্লাটফর্মে তালিকাভুক্ত বেশ কিছু কোম্পানিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ আটকে আছে, এ কারণে কিছু কোম্পানিকে স্মল ক্যাপিটাল প্লাটফর্মে স্থানান্তর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷

পাশাপাশি বেশ কিছু কোম্পানিকে এক্সিট প্ল্যানের মাধ্যমে বাজার থেকে বের হওয়ারও সুযোগ দেয়া হয়েছে৷ এরই অংশ হিসেবে ডিএসই ২০২২ সালে দুটো কোম্পানির (যশোর সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং আরবি টেক্সটাইল লিমিটেড) বিনিয়োগকারীদের অর্থ বুঝিয়ে দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে৷

স্টার্টআপ খাতের উন্নয়নে যৌথ গবেষনা পরিচালনা ও পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়, পুঁজিবাজার থেকে মূলধন উওোলনের বিষয়ে স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের অবহিতকরণের উদেশ্যে যৌথ প্রচারণা, আইপিও প্রক্রিয়া সম্পর্কিত তথ্য, নিয়মনীতি আদান প্রদানের সুবিধার্থে একটি হেল্প ডেক্স প্রতিষ্ঠা এবং আইপিও সম্ভাব্য প্রযুক্তি উন্নয়ন বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগীতাসহ সভা, সেমিনার, কনফারেন্স আয়োজনের লক্ষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে৷

শেয়ারবাজারের টানা পতন থামাতে দফায় দফায় স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা ও বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার পরও দরপতন ঠেকাতে না পেরে আবারও ফ্লোর প্রাইস বা শেয়ারের দামের সর্বনিম্ন সীমা বেধে দেয়া হয়েছে৷

২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধসের আগে থেকেই পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাবের ক্ষেত্রে শেয়ারের ক্রয়মূল্যেকে বাজার মূল্য হিসেবে বিবেচনার দাবি জানিয়ে আসছিল৷ এক যুগের বেশি সময় ধরে এ দাবি অমীমাংসিত ছিল৷ এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্ণর হিসেবে আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেয়ার পর বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নেন৷ সে অনুযায়ী গত ১৭ জুলাই ২০২২ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মতামত চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়৷ অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতিক্রমে ৪ আগষ্ট ২০২২ তারিখে শেয়ারের ক্রয়মূল্যকে ‘বাজারমূল্য’ ধরে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট হিসাব করার নির্দেশনা জারী করে বাংলাদেশ ব্যাংক৷

২ টি ট্রেকহোল্ডার কোম্পানী এপিআই কানেক্টিভিটি স্থাপন করে তাদের নিজস্ব ওএমএস এর মাধ্যমে লেনদেন শুরু করছে। এছাড়াও  ডিএসই থেকে ১১টি ট্রেকহোল্ডার কোম্পানিকে এপিআই ইউএটি সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। আশা করা যায় যে, অচিরেই এসকল কোম্পানি নিজস্ব অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ওএমএস) এর মাধ্যমে সরাসরি লেনদেন করতে পারবে। এরই ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে আগ্রহী সকল ট্রেকহোল্ডার কোম্পানিকে এ সুযোগের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে৷

বাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়াতে ব্লক মার্কেটে ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন দামের চেয়ে ১০ শতাংশ কম দামে শেয়ার বেচাকেনা করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে৷ বছরের একেবারে শেষভাগে শেয়ারবাজারে লেনদেনের গতি ফেরাতে তালিকাভুক্ত ১৬৯টি কোম্পানি ও মিউচ্যুায়াল ফান্ডের ওপর আরোপিত ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন মূল্যস্তর তুলে নেয়া হয়, তবে একদিনে সর্বোচ্চ ১ শতাংশের বেশী কমতে পারবে না৷

ডিএসই’র বর্তমান বোর্ডের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হল এক্সচেঞ্জের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আধুনিক ডেটা সেন্টার তৈরি করা। এই উদ্দেশ্যে ট্রেকহোল্ডারদের ট্রেডিং এর সুবিধার্থে ম্যাচিং ইঞ্জিন ও অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ওএমএস) হোস্ট করার জন্য ডিএসই টাওয়ার নিকুঞ্জে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ১০৬টি  রেকের সুবিধা সম্বলিত একটি টায়ার-৩ ডেটা সেন্টারের কাজ  চুড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ডেটা সেন্টারের হার্ডওয়ার স্থাপনের কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে যে প্রয়োজনীয় সফট্ওয়্যার সংযোজনের পর শীঘ্রই ডাটা সেন্টার চালু করা সম্ভব হবে।

জাতীয় অর্থনীতির নিরবিচ্ছিন্ন প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের পুঁজিবাজারে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডিএসই’র সেবা ও কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় এর প্রযুক্তিগত ঝুঁকিও অনেক বেশি। কোন দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের পুঁজিবাজারের কার্যক্রমকে অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারে। সম্ভাব্য ঝুঁকি ও বিপর্যয় রোধের মাধ্যমে পুঁজিবাজারের কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্নভাবে সচল রাখতে মোনায়েম বিজনেস ডিসট্রিক্ট এ ২৪ রেকের একটি ডিজাস্টার রিকভারি (ডিআর) সাইট স্থাপনের কাজও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ডেটা সেন্টার এবং ডিআর প্রবর্তনের মাধ্যমে ডিএসই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে প্রবেশ করবে এবং ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মের  সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।

পুঁজিবাজারের বিগত বছরের অবস্থা এবং সামনের বছরের বেশকিছু পরিকল্পনা নিয়ে ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) এম. সাইফুর রহমান মজুমদার, এফসিএ, এফসিএমএ বলেন, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বৈশ্বিক অর্থনীতি টানাপোড়নের মধ্যদিয়ে যাচ্ছিল, এরই ধারাবাহিকতায় বছরের শেষভাগে দেশের পুঁজিবাজার একটা বিয়ারিশ ট্রেন্ড পার করে৷

২০২৩ সালের শুরুতেই এই সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা৷ এর মূল কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতি তার বৈশিষ্টগত (Resilience) সহনশীলতার কারণে বিভিন্ন সূচকের অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে৷ তাছাড়া ২০২৩ সালের শুরুতেই ডিএসই’র অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড চালু করণ, মোবাইল অ্যাপস এর ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি, বন্ড মার্কেটের জন্য স্বতন্ত্র অর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিসে্টম প্রতিষ্ঠাসহ বাজারের অধিকতরস্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং গুণগত সম্প্রসারণের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে৷ আমরা আশাকরি পুঁজিবাজারে এর সুফল বয়ে আনবে৷

পুঁজিবাজারের সব খবর পেতে জয়েন করুন 

Sunbd Newsক্যাপিটাল নিউজক্যাপিটাল ভিউজস্টক নিউজশেয়ারবাজারের খবরা-খবর

সানবিডি/এসকেএস