চোরাই পথে আসছে নকল ইলিশ

আপডেট: ২০১৬-০৪-০৯ ১৩:৪২:০০


fake-hilshaভারতের গুজরাট থেকে চোরাইপথে আরব সাগরের স্বাদহীন নকল ইলিশ আসছে বাংলাদেশে। সরাসরি ঘোষণা না দিয়ে, অন্য মাছের ভেতরে প্যাকিং করে এ মাছ বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে কলকাতার হাওড়া মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। খুলনা, যশোর, পাবনা এবং ঢাকার কতিপয় ব্যবসায়ী এ মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাচ্ছেন।

পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে এ ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার মণ গুজরাটি নকল ইলিশ আনছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। চোখের দেখায় এ মাছকে বাংলাদেশের ইলিশ থেকে আলাদা করার উপায় নেই। রান্নার পর মুখে তুললেই কেবল বোঝা যায় গণ্ডগোলের বিষয়টি। ইলিশ তো দূরের কথা মাছের স্বাদ-ই নেই এই মাছে।

মাঝ থেকে অবৈধ পন্থায় এভাবে ইলিশ সদৃশ্য গুজরাটি মাছ এনে একদিকে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন একশ্রেণীর ব্যবসায়ী আর অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। বেশ কয়েক বছর ধরেই মিয়ানমার থেকে কম দামে স্বাদহীন ইলিশ এনে বাংলাদেশে দেশী ইলিশ বলে বেশি দামে চালাচ্ছে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হলেও তা বন্ধ হয়নি।

সুযোগ পেলেই তারা মিয়ানমার থেকে ইলিশ নিয়ে আসেন। এ প্রতারণার সঙ্গে এবার নতুন মাত্রা যোগ করেছে গুজরাটের নকল ইলিশ। বরিশাল ইলিশ মোকামের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী জহির সিকদার বলেন, ‘মূলত দেশে যখন ইলিশের আকাল থাকে তখনই এ ধরনের প্রতারণার লিপ্ত হন বরিশালসহ দেশের কতিপয় চিহ্নিত ব্যবসায়ী।

মিয়ানমার-গুজরাটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে কম দামে স্বাদহীন ইলিশ সদৃশ্য এক প্রকার মাছ এনে তা দেশী পরিচয়ে বেশি দামে বিক্রি করেন তারা। চোখের দেখায় পার্থক্য করা যায় না বলে এ মাছ কিনে চরমভাবে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।’ ইলিশ ব্যবসায়ী কামাল হোসেন কুট্টি জানান, ‘বিশেষ করে পহেলা বৈশাখ এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জামাইষষ্ঠীসহ নানা উৎসব পার্বণে এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা বেশি ঘটে।

এসব অনুষ্ঠান সামনে রেখে বেড়েও যায় মিয়ানমার থেকে ইলিশ এবং গুজরাট থেকে নকল ইলিশ আমদানি। এ মাছ বৈধপন্থায় ঘোষণা দিয়ে আনা হয় না। আসে চোরাইপথে।’ বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ইলিশের সংকটকালীন মৌসুমগুলো সামনে রেখে স্রেফ পাচারের উদ্দেশ্যে কলকাতা থেকে প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার দূরের গুজরাটের নকল ইলিশ আনা হয় পশ্চিমবঙ্গে।

আকাশপথে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় কিংবা ট্রেনে ২৪ থেকে ২৮ ঘণ্টার মধ্যে এ মাছ এসে পৌঁছায় কলকাতার হাওড়া মার্কেটে। এখান থেকে প্রায় সারা বছরই বাংলাদেশে পাঠানো হয় রুই, ট্যাংরা, আইড়, বোল এবং পাবদাসহ নানা ধরনের মাছ। এসব মাছ অবশ্য বৈধ ঘোষণায় এলসির মাধ্যমে যথাযথ রাজস্ব পরিশোধ হয়েই আসে।

আর নকল ইলিশ আসে গোপনে এসব মাছের নিচে বরফ মোড়া হয়ে লুকিয়ে। ৪ এপ্রিল ভারত ফেরত যশোরের এক মৎস্য ব্যবসায়ী (পরিচয় প্রকাশে ইচ্ছুক নন) যুগান্তরকে বলেন, ‘হাওড়া মার্কেটে অসংখ্য ছোট ছোট প্যাকিং ঘর আছে। যেসব ঘরে বাক্সের মধ্যে বরফ দিয়ে প্যাকিং করে তা বাংলাদেশে পাঠানো হয়। আমি নিজের চোখে দেখেছি ওইসব প্যাকেটে প্রথমে বরফ ছিটিয়ে কাড়ি কাড়ি গুজরাটের নকল ইলিশ রেখে বরফ দিয়ে ঢেকে তার ওপর রফতানি ঘোষণায় থাকা অন্য মাছ সাজিয়ে প্যাকেট করার দৃশ্য।

বেনাপোলে খানিকটা কড়াকড়ি এবং ব্যস্ততা থাকায় গুজরাটের ওই মাছ বোঝাই প্যাকেট বাংলাদেশে ঢোকে সাতক্ষীরার ভোমড়া স্থলবন্দর দিয়ে। হয়তো ওখানকার দায়িত্বরতদের সঙ্গে এ মাছ আমদানি-রফানিকারকদের কোনো গোপন সমঝোতা রয়েছে। যে কারণে হাজার হাজার মাছের প্যাকেট ঢুকলেও এর কোনোটি খুলে পরীক্ষা করা হয়েছে তেমন রেকর্ড নেই ভোমরায়। ফলে খুব সহজেই বিনা বাধায় বাংলাদেশে ঢুকে যায় গুজরাটের নকল ইলিশ।

যা পরে দেশী ইলিশ বলে চড়া দামে বিক্রি হয়।’ বরিশাল মৎস্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুল জানান, ‘গুজরাটের আরব সাগরে ধরা পড়া ওই মাছের প্রকৃত নাম তার জানা নেই। তবে দেখতে অবিকল ইলিশের মতো হওয়ায় আনেকইে ইলিশ বলে ভুল করেন। এ মাছ আকারে খুব বড় হয়।

প্রতিটির সাইজ সোয়া থেকে দেড় কেজি। এর বিপরীতে দেশে বর্তমানে কেজি সাইজের ইলিশ মেলাই মুশকিল। ফলে খুব সহজেই এগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হয় ক্রেতাদের। যতদূর জানি হওড়ার বাজার থেকে ১ হাজার/১২শ’ টাকা কেজি দরে নকল এ ইলিশ কেনেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। এরপর চোরাইপথে দেশে এনে তা বিক্রি করা হয় আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা কেজি দরে। খুলনা এবং রাজধানী ঢাকার দুই ব্যবসায়ী বরিশালে সরবরাহ করেন গুজরাটের নকল ইলিশ।

এখানকার কয়েকজন ব্যবসায়ী সেগুলো এনে লোকাল ইলিশ বলে চালিয়ে দেন বাজারে। তিনি বলেন, এতদিন মিয়ানমারের ইলিশ নিয়ে চরম বিপদে ছিলাম। এখন নতুন করে যোগ হল গুজরাটের নকল ইলিশের উপদ্রব।’ এ ব্যাপারে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না- জানতে চাইলে টুটুল বলেন, ‘এটা তো ওপেন সিক্রেট। বলতে গেলে সবাই জানে।

আজ প্রায় ৫-৬ বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে ভারতসহ অন্য দেশে বন্ধ রয়েছে ইলিশ রফতানি। সরকারি নির্দেশে রফতানি বন্ধ থাকলেও চোরাইপথে দেদারসে ইলিশ যাচ্ছে ভারতে। আবার বার্মা থেকে ইলিশ এবং ভারত থেকে নকল ইলিশ এনে বিক্রি করা হচ্ছে দেশে। প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবার অগোচড়ে এতবড় ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়।’  সূত্র: যুগান্তর

সানবিডি/ঢাকা/এসএস