কে এই জুলহাস, কী আছে রূপবানে?
প্রকাশ: ২০১৬-০৪-২৬ ১০:৫২:৪৫
রাজধানীর কলাবাগানে দুর্বৃত্তদের হামলায় সোমবার সন্ধ্যায় নিহত হন জুলহাস মান্নান (৩৫) এবং তার সঙ্গী মাহাবুব রাব্বি তনয় (২৬)। তারা দুজনই ছিলেন বাংলাদেশে হিজড়া ও সমকামীদের অধিকার বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘রূপবান’ প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত। জুলহাস ছিলেন ম্যাগাজিনটির সম্পাদক, আর লোক নাট্যদলের সদস্য তনয় সরাসরি যুক্ত না থাকলেও এর প্রকাশনায় সহযোগিতা করতেন বলে জানা গেছে।
নিহত জুলহাস মান্নান কেবল ‘রূপবান’ ম্যাগাজিনের সম্পাদকই ছিলেন না, তার আছে আরো পরিচয়। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মণির খালাতো ভাই তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি-তে কর্মরত ছিলেন। এর আগে ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার প্রটোকল কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কলাবাগানের তেঁতুলতলা গলির আছিয়া নিবাস নামের ৩৫ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় নিজ ফ্ল্যাটে বন্ধু তনয়কে নিয়ে একসঙ্গে থাকতেন জুলহাস। ওই ফ্ল্যাটেই চাপাতির আঘাতে দুজনকে খুন করে দুর্বৃত্তরা।
সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি ছয়তলার ওই ভবনে প্রবেশ করতে চায়। ভবনের নিরাপত্তা প্রহরী পারভেজ তাদের দাঁড় করিয়ে দোতলায় যান। দুর্বৃত্তরাও পারভেজের পিছু পিছু উপরে উঠতে থাকে। দোতলায় কলিং বেল টিপতেই জুলহাজ বেরিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা তার মাথায় চাপাতির কোপ দেয়। জুলহাজের বন্ধু মাহবুব রাব্বি এগিয়ে এলে তাকেও কোপায় দুর্বৃত্তরা। দুজনের মৃত্যু নিশ্চিত হলে দুর্বৃত্তরা ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দিতে দিতে পালিয়ে যায়।
হামলাকারীদের গায়ে নেভি-ব্লু টিশার্ট ও প্রত্যেকের কাঁধে ছিল ব্যাগ আর হাতে ছিল অস্ত্র। কিলিং মিশন শেষ করে পালিয়ে যাওয়ার সময় লোকজন তাদের দেখে চিৎকার শুরু করলে দুর্বৃত্তরা ফাঁকা গুলি করতে থাকে। এরপর তারা কলাবাগানের ডলফিন গলি সংলগ্ন তেতুলিয়া মাঠের কাছে পৌছে। পেছনে ‘ডাকাত, ডাকাত’ বলে চিৎকার করতে থাকে লোকজন। এরপর টহল পুলিশের একটি দল ধাওয়া করে দুর্বৃত্তদের একজনকে ধরে ফেলে। পরে ওই এসআইকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে পালিয়ে যায় এক হামলাকারী।
নিহত জুলহাসের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে। তবে বড় হয়ে ওঠেছেন ঢাকাতেই। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ২০০৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর একাধিক এনজিওতে চাকরি করেছেন। ২০০৭ সালে থেকে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে প্রটোকল অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এরপর তিনি যোগ দেন ইউএসএআইডিতে। ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সমকামী, হিজরা এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ‘বয়েজ অব বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গেও কাজ করেছেন জুলহাস।
কলাবাগানের লেকসার্কাস রোডের আছিয়া নিবাস নামে ছয়তলা ওই একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলার নিজ ফ্ল্যাটে ৯০ বছর বয়সী মা সখিনা খাতুন ও তার বন্ধু তনয়কে নিয়ে থাকতেন জুলহাস। বাবা আবদুল মান্নান সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। দুই ভাই ও এক বোনের পরিবারে জুলহাস ছিলেন সবার ছোট। তার বড় ভাই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সহ সভাপতি মিনহাজ মান্নান ইমন। মেজ ভাই যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।
জুলহাসের সঙ্গে নিহত তনয় নাট্য সংগঠন লোক নাট্যদলের শিশু সংগঠন পিপলস থিয়েটারে জড়িত ছিলেন। বয়সে প্রায় ১০ বছরের ছোট মাহাবুব রাব্বি তনয়ের সঙ্গে জুলহাসের সমকামী সম্পর্ক ছিল বলে তাদের ঘণিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে।
সমকামীদের ‘সমপ্রেমী’ বলার আহ্বান জানিয়ে জুলহাস মান্নানের সম্পাদনায় ‘রূপবান’ ম্যাগাজিনের প্রকাশনা শুরু হয় দুই বছর আগে। ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি। অফসেট পেপারে ৫৬ পৃষ্ঠার চাররঙা এ ম্যাগাজিনটির প্রকাশক ছিলেন ‘গ্রে কমিউনিটি’-এর পক্ষ থেকে রাসেল আহমেদ। ওই সময় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেওয়া ‘রূপবান’ এর প্রকাশক ম্যাগাজিনটি সম্পর্কে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে যেখানে সমকামীরা ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হয়, সেখানে সমকামীদের স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি সমাজে ছড়িয়ে দিতেই এ প্রয়াস। বাংলাদেশে গে, লেসবিয়ান ও বাই সেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য এটা একটা বড় প্ল্যাটফর্ম।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সম্পাদক জুলহাস মান্নান ‘রূপবান’ প্রসঙ্গে বলেন, সমকাম নয়, বরং সমপ্রেমে বিশ্বাসী মানুষের ভালবাসার অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরতেই ‘রূপবান’-এর আত্মপ্রকাশ। এতে সমপ্রেমে বিশ্বাস করে এমন মানুষদের জীবনধারা, ভালোলাগা ও দুঃখ কষ্টের বিষয়টি তুলে ধরা হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সমকামীরা অদৃশ্য জীবনযাপন করে, কিন্তু আমরা জানাতে চাই যে এই সমাজেই আমরা আছি এবং আমরা আপনাদের পরিবারেরই সদস্য।
ম্যাগাজিনের নাম ’রূপবান’ রাখার কারণ ব্যাখা করে জুলহাস বলেছিলেন, নামটি নেয়া হয়েছে বাংলার একটি রূপকথার গল্প থেকে যেখানে রূপবান নামের একটি সুন্দরী মেয়েকে একটি বাচ্চা ছেলের সাথে বিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
বাংলাদেশের লেসবিয়ান, গেই, বাইসেক্সুয়াল ও ট্র্যান্সজেন্ডার (এলজিবিটি) মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ম্যাগাজিনটিকে বিরাট একটি পদক্ষেপ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা আশা করি এটা সমকামী সম্প্রদায়ের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে। রূপবান ম্যাগাজিনের সম্পাদকের প্রত্যাশা, সমকামীদের জীবনযাপন পদ্ধতি ও বিভিন্ন দিক নিয়ে ম্যাগাজিনটিতে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে, তা মানুষের মধ্যে সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সক্ষম হবে।
ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রকাশ হওয়া ’রূপবান’ এর প্রথম সংখ্যাটি বের হওয়ার পর পরই এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ জানিয়ে ম্যাগাজিনটির প্রকাশনা নিষিদ্ধের দাবি জানায় ইসলামভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠক।
এবারের বাংলা নববর্ষে ’রংধনু যাত্রা’ শিরোনামে রাজধানীতর টিএসসি এলাকা থেকে ‘রূপবান’-এর উদ্যোগে প্রথম প্রকাশ্যে সমকামীরা একটি র্যালি বের করার চেষ্টা করে। এর নেতৃত্বে ছিলেন জুলহাস মান্নান। র্যালি শুরুর ৫ মিনিটের মধ্যে পুলিশের বাঁধায় তা পণ্ড হয়ে যায়। এসময় জুলহাস মান্নানসহ চারজনকে আটক করে পুলিশ। পরে ক্ষমতাসীন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. দীপু মণির সুপারিশে ওইদিন রাতেই স্বজনদের জিম্মায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নববর্ষে র্যালি বের করার চেষ্টায় নেতৃত্ব দেওয়ায় প্রথাবিরোধী জুলহাস মান্নান ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের কোপানলে পড়ে যান। তিনি হয়ে ওঠেন জঙ্গিদের টার্গেট। জীবন দিয়ে এর মূল্য দিতে হলো জুলহাস ও তার সঙ্গী তনয়কে।
সানবিডি/ঢাকা/পিপি/এসএস