ঐতিহ্য হারাচ্ছে ছাত্র রাজনীতি

প্রকাশ: ২০১৬-০৪-২৮ ১৯:০৯:৪৭


Hridoyব্রিটিশ শাসনামলে ছাত্র আন্দোলন ছিল আদর্শিক ও নির্দিষ্ট ইস্যুভিত্তিক। সে সময় ছাত্র নেতাকর্মীরা ছিলেন সাহসী ও রাজনৈতিক অধিকার সচেতন। সরকারের ক্ষমতার প্রভাবে নয়, দেশের ও বর্হিবিশ্বের স্বৈরাচারী শাসকদের অত্যাচার ও বাধা উপেক্ষা করেই ছাত্র আন্দোলন অব্যাহত রাখতেন। তেমনি অতীতেও এই বাংলা ভূখ-ে ছাত্র আন্দোলন ছিল। বর্তমান সময়ের ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে ছাত্র সংগঠনগুলোর দলীয় লেজুড়বৃত্তি আর রাজনৈতিক উদাসীনতা।

অতীতে ছাত্র আন্দোলন ছিল বড় বড় দক্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির সূতিকাগার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ পরবর্তী সময়ের তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, রাশেদ খান মেনন প্রমুখ ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সুযোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলনে এর সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র দেখতে পাই। এখন বড় বড় ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা ছাত্র রাজনীতির চর্চা করতে গিয়ে দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। নানা সুযোগ সুবিধা আর অর্থ ও প্রতিপত্তির লোভে আদর্শবোধের চেতনা সেখানে থাকে না। এই ছাত্র রাজনীতি ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি করতে পারছে না। অর্থাৎ, ডান বা বাম কোন রাজনৈতিক দল পারছে না নতুন ও যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি করতে।

এই ভূখ-ের যে রাজনীতি শের-ই-বাংলা থেকে বঙ্গবন্ধুর মত আদর্শ ও ক্ষণজন্মা নেতাদের জন্ম দিয়েছে। আজ সেই ভূখ- অনুর্বর হয়ে গেছে। আর এখনকার ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়ে আদর্শচ্যুত ও অসৎ রাজনৈতিক সংগঠক তৈরি হচ্ছে। বর্তমান এ অবস্থার জন্য শুধু ছাত্র রাজনীতি দায়ী নয়। দায়ী সন্ত্রাসপ্রবণ ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক মূলধারা আর লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র সংগঠন।
ব্রিটেনে কনজারভেটিভ পার্টির যেমন ছাত্র সংগঠন আছে তেমনি আছে লেবার ও লিবারেল ইত্যাদি পার্টির সমর্থক ছাত্র সংগঠন। তারা কখনো প্রধান দলের লেজুড়বৃত্তি করে না। তবে আদর্শিক ও ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচিতে সমর্থন দেয়। আর মূল দলও তাদের নিয়ন্ত্রণ করে না। এমনকি মূল দল ক্ষমতায় গেলে তাদের সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিশেষ কোন আশ্রয় পায় না। এজন্য ইউরোপে ছাত্র রাজনীতির চর্চা পরিচ্ছন্ন ও ইস্যু ভিত্তিক।

বাংলাদেশে একটা সময় এই অবস্থা ছিলো কিন্তু একাত্তরের পরবর্তী মূলদল বা ক্ষমতাসীন দলগুলো তাদের অনুগত ছাত্র সংগঠনগুলোকে অবাধ সুযোগ দানের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতির আদর্শের পথ ধ্বংস করে দিচ্ছে। আর একটা কারণ শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষাদান ও চরিত্র গঠনের সাহায্যদানের পরিবর্তে তাদের নিজেদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। আর এটা এক শ্রেণীর শিক্ষকের কাছে রাজনৈতিক বা অনৈতিক ব্যাপার নয়। বাংলাদেশেও ছাত্র সংগঠনগুলোর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ছিল স্বাধীনতার আগে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্ররাই ছিল মূলশক্তি। অতঃপর ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অর্থাৎ মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্ররাই ছিলো প্রথম সারিতে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগের বেশিই ছিলো তৎকালীন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা।

আর বর্তমান সময়ের ছাত্র রাজনীতি হয়ে পড়েছে লক্ষ্যভ্রষ্ট, দায়িত্ব ও আদর্শহীন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নিছক লেজুড়বৃত্তিক। লক্ষ বা কোটি টাকায় নেতৃত্ব বেচাকেনার প্রতিযোগিতা, আধিপত্য বিস্তারের মহড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিবাণিজ্য বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল দখলের প্রচেষ্টা, টেন্ডারবাজি, মিছিল-মিটিংয়ে বোমা হামলা, প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা, অন্তঃকোন্দল ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন, মেয়েদের উত্যক্ত করা ও জোরপূর্বক তুলে এনে চাঁদা দাবি করা বর্তমান ছাত্র সংগঠনগুলোর নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। প্রায় সবগুলো ছাত্র সংগঠনের সামগ্রিক অবস্থা মুদ্রার এপিঠওপিঠ। রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা সবকিছুই করছে।

অন্যদিকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছাড়াই চলছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সাধারণ ছাত্রদের অধিকার ও ন্যায্যতা আদায়ের প্রাণকেন্দ্র এই ছাত্র সংসদ। পাশাপাশি যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির সূতিকাগারও এই ছাত্র সংসদ। কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলোর, সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক উদাসীনতা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলার কারণে বছরের পর বছর হচ্ছে না এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন। দেশের চারটি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যকর নেই ছাত্র সংসদ ব্যবস্থা। আর এ কারণেই তৈরি হচ্ছে না যোগ্য নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ডাকসু’ প্রতিষ্ঠার পর এই বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রত্যেকটি অধিকার ও স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু দুই যুগ ধরেও কার্যকর নেই দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট খ্যাত এ ছাত্র সংসদ। ফলে স্থবিরতা বিরাজ করছে ছাত্র রাজনীতিতে। আশানুরূপভাবে গড়ে উঠছে না মেধাবী ও ভবিষ্যত ছাত্রনেতৃত্ব। দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে, ছাত্র রাজনীতির অতীত ঐতিহ্য ও গৌরব।

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের মঞ্চ ‘রাকসু’ দীর্ঘদিন ধরে গুমরে কাঁদছে। রাকসুর অবকাঠামোগুলোর স্বকীয়তা দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পরবর্তী ১৯৮৯ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। যার কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে গড়ে উঠছে না ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ছাত্রনেতৃত্ব।

একই অবস্থা চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও। অচল হয়ে পড়েছে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু)। ফলে সংকট দেখা দিয়েছে ছাত্রনেতৃত্বের। শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কোন আন্দোলন না হওয়ায় শিক্ষাঙ্গনে বিরাজ করছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। আর লোপ পেয়েছে ভিন্নমতের রাজনৈতিক সহাবস্থান। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যথাযথ উদ্যোগের অভাব আর উদাসীনতায় বিকল হয়ে পড়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ।

ছাত্ররাজনীতির বর্তমান অবস্থা সর্ম্পকে কথা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, বর্তমানে ছাত্র সংগঠনগুলোতে রাজনীতির চর্চা বাদ দিয়ে অস্ত্রবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি ইত্যাদির চর্চা হচ্ছে। এখনকার ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে অদক্ষ, অযোগ্য নেতৃত্ব। আর এতে করেই প্রকৃত ছাত্র রাজনীতির চর্চা হচ্ছে না। ফলে দক্ষ নেতৃত্ব তো তৈরি হচ্ছেই না বরং ছাত্র রাজনীতি তার মূল জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে। ছাত্র রাজনীতি তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। দক্ষ, যোগ্য ছাত্র নেতৃত্ব তৈরি করতে হলে ছাত্র সংগঠনগুলোকে সঠিক ছাত্র রাজনীতির চর্চায় ফিরে আসতে হবে।

এ বিষয়ে কথা হয় রাবির আইন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী হাসিবুজ্জামান সৌরভের সঙ্গে। তিনি বলেন, ছাত্র রাজনীতি আসলে ছাত্রদের কল্যাণে হওয়ার কথা। কিন্তু এদেশে তা কখনও হতে দেখি না। দলীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রদের ব্যবহার করে। এর ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতির প্রতি উৎসাহ হারায়। মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতির প্রতি আগ্রহী না হলে দেশেরই ক্ষতি। তাই ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি করার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন।

সবশেষ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যদি কলুষমুক্ত হয় তবেই ছাত্রসংগঠনগুলোর জন্য আদর্শের রাজনীতি চর্চার পথ প্রশস্ত হবে। ফিরে আসবে হারিয়ে যাওয়া অতীতের ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্য ও গৌরব। তাই এখনই দেশ ও সমাজের স্বার্থে ছাত্ররাজনীতির চর্চাকে কলুষমুক্ত ও দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে হবে।

সানবিডি/ঢাকা/আহো