মানবতার জন্য ৪ হাজার মাইল পাড়ি
প্রকাশ: ২০১৬-০৫-২২ ১১:৪৯:৩৪
মানবতার জন্য ৪ হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছলেন জুলি জোন্স নামের এক নারী। সেইসঙ্গে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত এক কিশোরকে সুস্থ করে অবিশ্বাস্য কীর্তি স্থাপন করলেন তিনি।
দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ভারতের মধ্য প্রদেশের এক যুবককে নতুন জীবন দিয়েছেন ইংল্যান্ডের বাসিন্দা জুলি। তিনি পেশায় এন এইচ এস সার্জন।
মাহিন্দ্র আহিরওয়ার নামের ১৩ বছর বয়সী কিশোর কোনজেটাল মাইওপ্যাথি (Congenital Myopathy) নামের এক রোগে আক্রান্ত হয়।
যার ফলে তার গলা ১৮০ ডিগ্রি ঝুলে যায়। অনেক চেষ্টা করেও তাকে সুস্থ্য করতে পারেনি। একসময় তার পরিবার আশা ছেড়ে দেয়।
তারপর ইংল্যান্ডের লিভারপুলের জুলি জোন্স মাহেন্দের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। চ্যানেল ফাইভে মাহেন্দরের সংবাদ শুনে তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন জুলি। একপর্যায়ে অপারেশনের মাধ্যমে মাহিন্দ্রকে সুস্থ করে তোলেন।
প্রথমে জুলি জোন্স ওই কিশোরকে সাহায্য করার জন্য ক্রাউড ফান্ডিং নামে একটি সাইট খোলেন। ২৪ দিন পর সেখানে জমা হয় ১২ হাজার পাউন্ড, বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ১৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ একটি অপারেশন করে মাহিন্দ্রর গলাকে সোজা করা হয়।
সম্প্রতি এই অসাধ্য কাজটি করার জন্য জুলি ও মাহিন্দ্রকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র বানানো হয়। সেখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই অবিশ্বাস্য কাজটি দেখানো হয়েছে।
এক সময় ডাক্তাররা মাহেন্দ্রকে নিয়ে সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এমনকি বলেছিলেন এই অপারেশন করা হলে তার মৃত্যুও হতে পারে।
ঠিক সেসময় এই ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশান করেছেন রাজাগোপালান কৃষ্ণাণ নামের এক ডাক্তার। তিনি দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালের একজন সিনিয়র সার্জন। আজ থেকে ১৩ বছর আগে তিনি লন্ডনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে কাজ করতেন। তারপর দেশে ফিরে অ্যাপোলো হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনগুলো নিয়ে কাজ করছেন।
ডাক্তার কৃষ্ণাণ অপারেশন করতে গিয়ে মাহিন্দ্রর গলার সামনের দিকের বাঁকা অংশ খুলে ফেলেন। এরপর সার্ভিক্যাল মেরুদণ্ডের সামনের দিকে কৃত্রিম একটি হাঁড় বসিয়ে সেটিকে সোজা করেন।
মাহিন্দ্রের সার্ভিক্যাল মেরুদণ্ড খুব পাতলা ছিল। তার গলার বাঁকানো যে চাকতি ছিল, তার পরিবর্তে একটি কৃত্রিম হাড় বসানো হয়েছে। গলাকে সোজা রাখার জন্য মেটাল প্লেট ব্যবহার করা হয়েছে। এই অপারেশন করতে প্রায় দশ ঘণ্টা সময় লেগেছে। পুরো সময় চ্যানেল ফাইভে দৃশ্যগুলো ধারণ করা হয়েছে।
জুলি ও মাহিন্দ্রকে নিয়ে নির্মিত ডকুমেন্টারিতে মাহিন্দ্রকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া, অপারেশন করানো, আবার বাড়িতে ফেরত আনার সব দৃশ্য ধারণ করা হয়।
মাহিন্দ্রর বাবা মা এক সময় সব আশা ছেড়ে দেন। তাদের সন্তান আর কোনোদিন সুস্থ হবে না বলে ধরে নেন। সন্তানের মুখে হাসি দেখে এখন তারা অনেক খুশি।
এ বিষয়ে মাহেন্দ্রর বাবা মুখেশ আহিরওয়ার বলেন, ‘দুবছর আগেই আমরা চিকিৎসা করা বাদ দিয়েছ। আমরা আশাও করিনি যে, মাহেন্দ্র ভাল হবে। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, হয়তো এভাবেই তাকে কষ্ট করে সারাজীবন বেঁচে থাকতে হবে।’
মাহেন্দ্রর মা বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মাহিন্দ্র খাবার খেতে চাইতো। পোশাক পরিয়ে দিতে বলতো। যদিও খাবার খেতে পারতো না। যখন তার অন্য বন্ধুরা মাঠে খেলত তখন সে বিছানায় পড়ে থাকে। একজন মা হিসেবে কীভাবে এটা সহ্য করেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’
এ বিষয়ে জুলি জোন্স বলেন, ‘আসলে সবাই তাকে সাহায্য করতে চাচ্ছিল। কিন্তু কেউ সাহস করে এগিয়ে আসেনি। তখন আমি আমার ল্যাপটপটা হাতে নিলাম এবং ক্রাউড ফান্ডে অ্যাকাউন্ট করলাম। প্রায় ২৪ দিন পর অ্যাকাউন্টে ১২ হাজার পাউন্ড জমা হয়। আমি এর আগে কখনো স্পেন ছাড়া কোথাও ছুটি কাটাতে যাাইনি। তাই বিমানে উঠতে একটু ভয় করছিলো। কিন্তু মাহিন্দ্রকে সরাসরি দেখার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল। তাই আমি রাজি হয়ে গেলাম। বিমানে ওঠা থেকে শুরু করে দিল্লি পর্যন্ত সবসময় সাংবাদিকরা আমার দিকে ক্যামেরা ধরে রেখেছিলেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘এরকম পরিস্থিতিতে কখনো আমি পড়িনি। যেমন কোনো রাত বাইরে ঘুমানো, অনেকগুলো অপরিচিত মানুষের সামনে যাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু যখন আমি মাহেন্দ্র ও তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করলাম। তখন মনে হলো আমি অপার্থিব কোনো সম্পদ। তাদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি তা আমার সারা জীবনের কর্ম দিয়েও পূরণ হবে না। যখন মাহেন্দ্রের মার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়, তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে তিনি কাঁদছিলেন। আবার যখন বিদায় নিয়ে আসি তখনও কাঁদছিলেন।’
জুলি জোন্স দিল্লিতে বেশিদিন ছিলেন না, কিন্তু এরমধ্যেই মাহেন্দ্র ও তার পরিবারের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার।
এ বিষয়ে জুলি জোন্স বলেন, ‘আমি এত ভালোবাসা পাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। যখন তার আগের ও পরের দুটি ছবি দেখি, তখন আমার খুব ভালো লাগে। তাকে ছেড়ে আসতে মন চাচ্ছিল না। স্বল্প সময়ের ভ্রমণে মাহেন্দ্র আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। যদিও আমি আর কখন তাকে কাছ থেকে দেখতে পাব না।’
অপারেশনের পর মাহেন্দ্রকে একটি গলা বন্ধনী দেওয়া হয়েছে। যেটা ছয় মাস গলায় রাখতে হবে। সেইসঙ্গে ডাক্তার কৃষ্ণাণের সাথে প্রতিদিন দিল্লিতে দেখা করতে হবে।
ডাক্তার কৃষ্ণাণ বলেন, ‘এটা কোনো বিষয় না। খুব তাড়াতাড়ি মাহেন্দ্র পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে।’
মহেন্দ্র বলেন, ‘আগে আমার ভাল হওয়ার কোনো আশা ছিল না। এখন জীবন নিয়ে নতুন করে আশা জেগেছে। আমি জীবনে সফল হতে চাই।’
ডাক্তার কৃষ্ণাণ বলেন, ‘আমি যখন মাহেন্দ্রর সাথে প্রথম দেখা করি তখন ভাবতে পারিনি তাকে এতটা সুস্থ করে তুলতে পারব। তবে আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম, হয়তো তার অবস্থা এর চেয়ে ভালো করতে পারব। যেখানে গত ১২ বছর ধরে অন্য ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। সেখানে আমাকে আগেই ভাবতে এবং নিশ্চিত হতে হয়েছে যেন কিছুতেই মাহেন্দ্র মারা না যায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘মাহেন্দ্রের যে রোগ হয়েছে তার নাম অ্যানেস্থেশিয়া (anesthesia)। কিন্তু সেটি আমি আজ জানতে পারলাম। তার গলায় আরো কয়েকটি সার্জারি করা দরকার। সেগুলো যখন তার গলার অবস্থা আরো ভালো হবে তখন করা যাবে।’
সানবিডি/ঢাকা/এসএস