নিরুৎসাহিত পণ্য থেকেই বিপুল লভ্যাংশ নিচ্ছে সরকার
প্রকাশ: ২০১৬-১০-০৯ ১০:৩৫:৩৮
দেশে ধূমপান বা তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে সোচ্চার সরকার। এর অংশ হিসেবে চলছে তামাকবিরোধী সচেতনতামূলক নানা কর্মকাণ্ড। এ-সংক্রান্ত আইন পরিপালনে রয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালতও। যদিও তামাকপণ্য বিক্রি থেকে বড় অংকের মুনাফা পাচ্ছে সরকার। বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোয় (বিএটি) সরকারের মালিকানা থেকে এ মুনাফা আসছে। সরকারের এ অবস্থানকে পরস্পরবিরোধী বলে মনে করছেন অনেকেই।
দেশে তামাক উৎপাদনকারী, বিপণন ও বাজারজাতকারী সবচেয়ে বড় কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোং (বিএটিবিসি)। ২০১৫ হিসাব বছর অনুযায়ী, কোম্পানিটিতে সরকার ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার রয়েছে ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারের শেয়ার শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ। এছাড়া সরকারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) শেয়ার রয়েছে ৭ দশমিক ১৭, সাধারণ বীমা করপোরেশনের ২ দশমিক ৮২ ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ।
আইসিবি গঠন হওয়ার পর সরকারি অংশের বেশির ভাগ শেয়ার প্রতিষ্ঠানটিতে স্থানান্তর করা হয়। ২০১০ সালে আইসিবির হাতে বিএটিবিসির ১৭ দশমিক ৪১ শতাংশ শেয়ার ছিল। পরবর্তীতে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার বিএটিবিসির মূল উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান রেলিহ ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয় আইসিবি।
২০১৫ সালে সরকার ও এর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বিএটিবিসি থেকে শুধু লভ্যাংশ হিসেবে পেয়েছে ৩৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লভ্যাংশ বাবদ বিএটিবিসি থেকে পেয়েছে ৪০ কোটি, ২০১৩ সালে ৫২ কোটি ও ২০১২ সালে ৩৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ২০১১ সালে কোম্পানিটি থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লভ্যাংশ পেয়েছিল ৪৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এর বাইরে বিএটিবিসি থেকে সরকারি কোম্পানিগুলোর বড় অংকের মূলধনি মুনাফাও হচ্ছে।
তামাকবিরোধী অবস্থানের কারণে এ ধরনের কোম্পানিতে সরকারের মালিকানা থাকা উচিত নয় বলে মনে করেন অনেকে। গত বাজেট অধিবেশনে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, তামাক কোম্পানিতে সরকারের মালিকানা থাকা উচিত নয়। সরকারের কোনো প্রতিনিধিরও সিগারেট কোম্পানির পরিচালক পদে থাকা সমীচীন নয়।
গতকাল যোগাযোগ করা হলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, বিড়ি-সিগারেটের মতো জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো পণ্যের ব্যবসায় সরকারের অংশীদারিত্ব থাকা উচিত নয়। ধূমপান নিরুৎসাহিত করতে সরকারের উচিত সিগারেট কোম্পানির মালিকানা ছেড়ে দেয়া। একই সঙ্গে বিড়ি-সিগারেটে আরো বেশি কর ধার্য করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ ধূমপানে নিরুৎসাহিত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ‘ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল’-এ স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, ব্যবহার, ক্রয়-বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ২০০৫ সালে আইন করে সরকার। যদিও এর প্রয়োগ সীমিত। তামাক উৎপাদন ও এর ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার প্রক্রিয়াটি শুধু প্রচারণায়ই সীমাবদ্ধ। এর প্রমাণ পাওয়া যায় এ খাতের সবচেয়ে বড় কোম্পানি বিএটিবিসির তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহারের পরিসংখ্যানে। কারণ দেশে সিগারেট বিক্রির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই করে বিএটিবিসি।
কোম্পানিটির হিসাব বলছে, ২০১০ সালে বিএটিবিসি সিগারেট বিক্রি করে মোট ২ হাজার ৬০৬ কোটি শলাকা, যা থেকে তাদের আয় হয় ৬ হাজার ৩২৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। ২০১৫ সালে স্থানীয় বাজারে সিগারেট বিক্রি বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৫৪ কোটি শলাকায়। এ থেকে কোম্পানিটির আয় হয় ১৪ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। এ সময় সম্পূরক কর ও ভ্যাট বাবদ সরকারি কোষাগারে কোম্পানিটি জমা দেয় ১০ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা।
মূল প্রতিষ্ঠান বিএটির ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে যে পাঁচটি দেশকে মুনাফার জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। সিগারেটের সংখ্যা, মূল্য ও মার্কেট শেয়ার বৃদ্ধির কারণেই বাংলাদেশে বিএটিবিসির মুনাফা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। আর এর অংশ পাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
যদিও তামাকজাত পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিরুৎসাহিত করছে সরকার। দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি এবং ডেন্টাল কলেজ ধূমপানমুক্ত রাখতে বিভিন্ন সময় সরকারের অবস্থানের কথা তুলে ধরেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। গত এপ্রিলেও এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এখন থেকে কোনো ধূমপায়ী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। এমনকি প্রথম হলেও না।
একদিকে তামাকবিরোধী এ প্রচারণা, অন্যদিকে তামাক কোম্পানি থেকে লভ্যাংশ গ্রহণকে সরকারের পরস্পরবিরোধী অবস্থান বলে মনে করেন তামাকবিরোধী জোটের সমন্বয়কারী সাইফুদ্দিন আহমেদ। নৈতিকতার স্বার্থে এ অবস্থান থেকে সরকারের সরে আসা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আর তামাক কোম্পানিতে এ অংশীদারিত্ব সরকারের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মত দেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দিচ্ছে, আইনের বিধিবিধান কঠোর করার কথা বলছে। কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে, আবার সরকার নিজেই সেখান থেকে মুনাফা অর্জন করছে। এটা তো এক ধরনের স্ববিরোধিতা। সরকারের উচিত এ অবস্থান থেকে সরে আসা।
ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের কারণ তামাকপণ্য ব্যবহার। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, ফুসফুস ক্যান্সারের ৯৬ শতাংশের কারণ ধূমপান। পাশাপাশি হূদরোগ, মুখের ও খাদ্যনালির ক্যান্সারেরও অন্যতম কারণ তামাকজাত পণ্য ব্যবহার। ডব্লিউএইচওর হিসাব অনুযায়ী, সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর ৫০ লাখ মানুষ মারা যায় ধূমপানজনিত রোগের কারণে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে এক কোটিতে।
স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি কৃষিজমির উর্বরা শক্তিও কমিয়ে দিচ্ছে তামাক চাষ। তামাক চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও ভুগছে বিভিন্ন ধরনের রোগে। তার পরও দেশে বাড়ছে তামাকজাত পণ্য বিক্রি ও ব্যবহার।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি তো মনে করি, সরকার তামাকের বিরুদ্ধে নয়। মাঝে মধ্যে এর বিরুদ্ধে কিছু কথা এলেও বাস্তবতার সঙ্গে তার মিল পাওয়া যায় না। বাজেটে ১ শতাংশ সারচার্জ আরোপের মাধ্যমে তামাকপণ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তা যথার্থ নয়। দেশে তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হওয়ায় কোনো উদ্যোগ কাজে আসছে না। তামাকের বিরুদ্ধে নীতিমালা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয় না।
তামাক কোম্পানিতে সরকারের মালিকানার বিষয়ে তিনি বলেন, এসব কোম্পানিতে সরকারের মালিকানা অনৈতিক হলেও দরকার আছে। তাতে কোম্পানিগুলোর ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকে। কোম্পানির পর্ষদে সরকারের প্রতিনিধি থাকায় তারা ইচ্ছামতো যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সূত্র: বনিকবার্তা