চার অভিযানে ১২ জঙ্গি নিহত
প্রকাশ: ২০১৬-১০-০৯ ১২:২৭:৫০
গতকাল শনিবার গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও ঢাকার আশুলিয়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে সন্দেহভাজন ১২ জঙ্গি নিহত হয়েছে। জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে পুলিশ ও র্যাব চারটি স্থানে পৃথক অভিযান চালায়। এর মধ্যে গাজীপুরের হাড়িনালের পশ্চিমপাড়ায় দু’জন ও নোয়াগাঁও এলাকার পাতারটেকে সাতজন নিহত হয়। টাঙ্গাইলে নিহত হয়েছে দুজন। সর্বশেষ ঢাকার আশুলিয়ায় র্যাবের অভিযানের সময় পালাতে গিয়ে আহত একজন মারা গেছে। তার নাম আব্দুর রহমান ওরফে আইনুল ওরফে নাজমুল হক। র্যাব জানিয়েছে, আব্দুর রহমান জেএমবির অর্থের মূল যোগানদাতা।
গাজীপুর মহানগরীর পাতারটেকে অভিযান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, সেখানে সাত জঙ্গি নিহত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত যে, তামিম চৌধুরীর পর যে নেতৃত্ব দিত ছদ্মনাম হোক আর তাদের সাংগঠনিক হোক তার নাম হচ্ছে আকাশ। সে এখানে নিহত হয়েছে, সেই সাতজনের মধ্যে একজন। অন্যদের পরিচয় জানি না।’
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, পাতারটেক এলাকার অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন শরতের তুফান’। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অপারেশনের নাম বাংলায় রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন অনেক বিশিষ্টজন। তাদের কথামতোই এবারের নাম বাংলায় দেওয়া হয়েছে।
গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ বলেন, ‘জেএমবির ঢাকা বিভাগীয় কমান্ডার আকাশ তার সঙ্গীদের নিয়ে নোয়াগাঁও এলাকার পাতারটেকে দোতলা একটি বাড়িতে অবস্থান করছে এমন খবর ছিল। এরই ভিত্তিতে সকাল ১০টার দিকে সেখানে অভিযান চালায় জেলা পুলিশ, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াট টিমের যৌথ দল। প্রথমে তাদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। কিন্তু তারা তা না করে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ও গ্রেনেড ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি করে। বেলা চারটা পর্যন্ত এ অভিযান চলে।’
এর আগে গতকাল ভোরে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকার হারিনাল পশ্চিমপাড়া লেবুবাজার এলাকার আতাউর রহমানের একতলা বাড়িতে অভিযান শুরু করে র্যাব। র্যাব-১ এর উপ-পরিচালক মহিউল ইসলাম বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এই জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছে। সেখানে দুজন নিহত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেন তিনি। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় কাগমারা গ্রামে আজাহার আলীর তিনতলা বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব-১২ এর একটি দল। এই অভিযানে দু’জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন র্যাব-১২-এর কমান্ডার ও এডিশনাল ডিআইজি শাহাবুদ্দিন খান। তবে নিহতদের পরিচয় জানা যায়নি।
গতকাল সকাল পৌনে ১১টার দিকে নোয়াগাঁওয়ের আফারখোলা পাতারটেক এলাকার একটি দোতলা বাড়িতে অভিযান শুরু করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, সঙ্গে ছিল সোয়াট। বিকালে অভিযান শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেন সেখানে সাতজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। তবে নিহতদের পরিচয় জানা যায়নি। তাদের বয়স ১৭ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বলে জানান ছানোয়ার। ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। রাতে লাশ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম ঘটনাস্থলে গিয়ে অভিযান তদারক করেন। র্যাব ও পুলিশের তিন অভিযানের খবরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও গাজীপুরে যান। পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী ও মোখলেসুর রহমান ছিলেন সেখানে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে যারা ছিল, সবাই জঙ্গি গ্রুপের সঙ্গে জড়িত। কিছু একটা করার জন্য তারা এখানে ছিল।’ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান বরখাস্ত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের কোনো সন্ধান পাওয়া গেছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেজর জিয়া বা লেফটেন্যান্ট জিয়া আমাদের কাছে ফ্যাক্টর না। কেউ পার পাবে না।’
গাজীপুরের নোয়াগাঁও এলাকার পাতারটেকের এই বাড়ির মালিক সৌদি প্রবাসী সোলেমান সরকার। তার ভাই কালীগঞ্জ উপজেলার জাঙ্গালিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আরবি শিক্ষক ওসমান গণি বাড়িটি দেখাশোনা করেন। তিন মাস আগে তার কাছ থেকে তিনজন বাড়িটির দোতলা ভাড়া নেয়। ওই তিনজন জঙ্গি বলে ধারণা পুলিশের।
অভিযান শুরুর আগে ছানোয়ার বলেছিলেন, ‘জেএমবির ঢাকা বিভাগীয় কমান্ডার আকাশ অবস্থান করছেন এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হচ্ছে।‘ অভিযানের পর তিনি বলেন, ‘সম্ভবত কমান্ডার আকাশ মারা গেছে। অভিযান শুরুর পর জঙ্গিরা ভেতর থেকে গুলি চালাতে শুরু করে বলে জানান কাউন্টার টেররিজমের প্রধান মনিরুল। তিনি বলেন, ‘নিচতলায় থাকা বাড়ির সদস্যদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার পর দোতলায় থাকা জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছিল। তখন জঙ্গিরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে জানালা দিয়ে গুলি করছে। তখন আমরা পাল্টা গুলি করি।
গাজীপুরের হারিনাল পশ্চিমপাড়া লেবুবাজার এলাকার অভিযানে যে দু’জন নিহত হয়েছেন তারা রাশেদুল (২০) এবং তৌহিদুল ইসলাম (২২) বলে বাড়ির মালিক আতাউর জানিয়েছেন। তৌহিদ ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েটে) শিক্ষার্থী এবং রাশেদ এবার এইচএসসি পাস করেছে। সাংবাদিক সম্মেলনে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ জানান, ঘটনাস্থল থেকে একটি নাইন এমএম পিস্তল, দু’টি ম্যাগাজিন, একটি একে টোয়েন্টি টু রাইফেল উদ্ধার করা হয়েছে। কিছু বিস্ফোরক ও একটি ল্যাপটপও পাওয়া গেছে সেখানে। র্যাব-১-এর গাজীপুর অঞ্চলের কমান্ডার মহিউল ইসলাম বলেন, লাশ দুটি উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে।
অন্যদিকে টাঙ্গাইল শহরের কাগমারা মির্জামাঠ এলাকায় একটি বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়েছে। র্যাব বলছে, সেখানে দুজন ‘জঙ্গি’ নিহত হয়েছে। তবে তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। র্যাব-১২-এর তিন নম্বর কোম্পানি কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকীর ভাষ্য, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে বাড়িটিতে সকাল ১০টার দিকে অভিযান চালানো হয়। ভেতরে ঢোকার পর এক জঙ্গিকে গ্রেফতার করতে গেলে ধস্তাধস্তি হয়। এ সময় অন্য জঙ্গিরা র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার চেষ্টা চালায়। র্যাবও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এতে দুজন জঙ্গি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। তাদের লাশ টাঙ্গাইল মেডিক্যাল কলেজ মর্গে রাখা হয়েছে। ওই ঘর থেকে একটি পিস্তল, একটি রিভলবার, ১০টি চাপাতি, দু’টি ছুরি ও ৬৪ হাজার ৯০০ টাকা উদ্ধার হয়েছে। ওই বাড়ির মালিক অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আজাহার আলী।
জেএমবির অর্থদাতা আটকের পর মৃত্যু
গতকাল সন্ধ্যায় সাভারের আশুলিয়ার একটি বাড়ি থেকে ৩০ লাখ টাকাসহ জেএমবির নাশকতার মূল অর্থদাতা আব্দুর রহমানকে আহত অবস্থায় আটক করে র্যাব। এর আগে পাঁচ তলা ভবন থেকে লাফ দিয়ে পড়ে পালাবার সময় সে আহত হয়। সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পর রাত ১২টার দিকে সে মারা যায়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন র্যাবের পরিচালক (মিডিয়া) মুফতি মাহমুদ খান।
তিনি বলেন, অর্থের যোগানদাতা আব্দুর রহমানকে র্যাব অনেক দিন থেকেই খুঁজছিল। সন্ধ্যায় আশুলিয়ার বাইপাইলে বসুন্ধরার টেক এলাকার আমিন হোসেন মৃধার বাড়ির ৫ তলায় অভিযান চালায় র্যাব। র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে জানালার গ্রিল কেটে লাফিয়ে পালাবার চেষ্টা করে রহমান। এ অবস্থায় র্যাব তাকে আহত অবস্থায় আটক করে । পরে বাসা তল্লাশি করে তার পাসপোর্ট থেকেই তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। এসময় বাসা তল্লাশি করে নগদ ৩০ লাখ টাকা, একটি খাতা, জিহাদি বই, অস্ত্র-বিস্ফোরকসহ অন্যান্য মালামাল জব্দ করা হয়। ওই খাতায় লেখা রয়েছে গুলশানে হলি আর্টিজান, শোলাকিয়াসহ বিভিন্ন হামলার ঘটনায় কী পরিমাণ টাকা প্রদান করা হয়েছিল।
র্যাবের মিডিয়া পরিচালক বলেন, আব্দুর রহমান ৬ মাস আগে আয়নাল নামে ওই বাসা ভাড়া নিয়েছিল। বাসায় থাকতো তার স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরও আটক করা হয়েছে। এছাড়া ওই বাড়ির কেয়ারটেকার তারেক মিয়াকেও আটক করেছে র্যাব।
এদিকে আশুলিয়ার পলাশবাড়িতে গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম গতকাল পৃথক অভিযান চালিয়ে অস্ত্র, চাপাতিসহ সোহেল ও জুয়েল নামের আরও দুই জঙ্গিকে আটক করেছে বলে জানা গেছে। সূত্র: ইত্তেফাক
সানবিডি/ঢাকা/এসএস