টেলিযোগাযোগ খাত, সিটিসেল ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

আপডেট: ২০১৬-১০-১২ ১৯:৩৫:৫১


mahmudulবিগত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতের  উন্নয়ন ও  বিস্তৃতি দেশের অর্থনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক টেলিকম ফোরামের সদস্য পদ পেয়েছে। আর ১৯৯৮ সালে দেশে মোবাইল ফোনের যাত্রা শুরু। এরপর ২০০২ সালে বিটিআরসি গঠনের পর তাতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। ২০১৬ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত টেলিকম থাতের সর্বমোট গ্রাহক ১২ কোটি ৮৯ লক্ষ ৩৯ হাজার যা দেশের প্রায় ৮০% জনসংখ্যার সমান। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।

 বর্তমানে এ খাতে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ২ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং রাজস্ব আয়ে ১০ শতাংশ অবদান রাখছে এ খাত। বিশ্লেষকদের অনেকেই টেলিকম কোম্পানিগুলোর চটকদার  বিজ্ঞাপন, বিতর্কিত অফার, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, মাত্রাতিরিক্ত কল রেটের ব্যাপারে বলেন ; কিন্তু তারপরও টেলিকম খাতের কারনে আমাদের দেশের জনগণের জীবন মানের যে উন্নয়ন ঘটেছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। উদাহরণস্বরূপঃ দেশে ইন্টারনেটের বিস্তার এবং মোবাইল ব্যাংকিং এর ব্যবহার বৃদ্ধির পেছনে টেলিকম খাতের অবদান অনেক।

এখনও টেলিকম খাত বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় খাত যেখানে দেশের জনসাধারণ কে দেওয়ার মত অনেক কিছু  আছে। দেশের জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশ এখনো ইন্টারনেট সেবার আওতার বাইরে। তাদের গ্রাহক হিসেবে আকর্ষণ করার মাধ্যমে বাজার বাড়ানোর সম্ভাবনার দিকে নজর দিচ্ছে টেলিকম অপারেটররা। বাংলাদেশে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো এই খাতে এখনো প্রবৃদ্ধির ভাল সম্ভাবনা দেখছে ।

সাম্প্রতিককালে সম্ভাবনাময় এই খাতের বেশ কিছু নেতিবাচক দিক আমাদের সামনে দৃশ্যমান । টেলিকম খাতের ব্যাপারে এখন থেকেই মনোযোগী না হলে দেশের অর্থনীতি এবং সামাজিক ব্যবস্থায় খারাপ প্রভাব পরতে পারে। বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল ফোন কোম্পানি  সিটিসেল এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় সিটিসেলের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

সিটিসেলের প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহককে অন্য অপারেটরের সেবা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে বিটিআরসি। যেখানে দেশের অন্যান্য টেলিকম কোম্পানিগুলো  দিন দিন নিজেদের সেবার পরিধি এবং বাজার বাড়িয়ে চলেছে সেখানে সিটিসেল এর মত কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়া দুঃখজনক। পৃথিবীর অন্যতম সফল মোবাইল অপারেটর সিংটেল সাথে থাকার পড়ও সিটিসেল নিজেদের পতন ঠেকাতে পারে নি। টেলিযোগাযোগ খাত অত্যন্ত বিনিয়োগ নির্ভর একটি খাত।

এখানে অনেক বড় অংকের বিনিয়োগ করলেও সাথে সাথে লাভের মুখ দেখা যায়না। দীর্ঘ মেয়াদিপরিকল্পনা থাকতে হয়। সেইসাথে বাজারে নতুন প্রযুক্তি আসে সেগুলোকে আমলে আনতে হয়।  সংশ্লিষ্টদের মতে সিটিসেল টিকতে না পারার অন্যতম কারণ এর ব্যবস্থাপনার গলদ এবং সঠিক সময়ে সিদ্ধান্তহীনতা।এছাড়া নতুন বিনিয়োগ ও আকৃষ্ট করতে পারে নি সিটিসেল। ২০১২ সাল থেকে সিটিসেলের সিংহভাগ শেয়ারের মালিক সিংটেল নতুন বিনিয়োগ বন্ধ করে দেয়ায় অর্থ সংকটে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি।  যেখানে অন্যান্য অপারেটররা গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশন প্রযুক্তির ব্যবহার করত   সেখানে সিটিসেল  কোড ডিভিশন মাল্টিপল অ্যাকসেস (সিডিএমএ) প্রযুক্তির সেবা দিত। সব অপারেটররা যখন থ্রিজি সেবা দিত সেখানেও সিটিসেল ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। থ্রিজির নিলামে সিটিসেল অংশ নিতে পারে নি।

সিটিসেলের এই ব্যর্থতার দায়ভার কোম্পানির ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত তাদের উপরই যায়। কিন্তু এই কোম্পানির ব্যর্থতার প্রভাব অর্থনীতি এবং সমাজের উপর ও পরবে। সিটিসেলের গ্রাহক যারা তাদের বলা হচ্ছে অন্য অপারেটরদের সেবা নিতে। কিন্তু এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার যে switching cost তা গ্রাহক কেই বহন করতে হবে। এছাড়া রবি আর এয়ারটেল একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারনে এখন টেলিকম সেক্টরের প্রতিযোগিতা অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে।

সিটিসেল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যাবে। শুরুর সময় থেকেই টেলিটক বাজারে শক্ত অবস্থান দখল করতে ব্যর্থ হয়েছে। টেলিকম খাতে এ কারনে এখন সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগিতা হবে তিনটি কোম্পানির ভেতর। আর প্রতিযোগিতা যত কমে ততই গ্রাহক সেবার মান কমে যাবে। সিটিসেলের ৬৫০ জন কর্মচারী – কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ ও আজ হুমকির সম্মুখীন। তাদের সকল বকেয়া, পিএফ, জিএফ ফান্ড নিয়ে কোন আশ্বাস কোন পক্ষ থেকেই দেওয়া হয় নি। কয়েক মাস আগে দেশের আরেক মোবাইল অপারেটর বাংলালিংকের কর্মকর্তা- কর্মচারী রাও মাঠে নেমেছিল কর্মী ছাটাই এর প্রতিবাদে। টেলিকম খাত আমাদের দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে এই কথা ঠিক। কিন্তু সেখানকার কর্মীদের কি অবস্থা সে দিকে এখন নজর দেওয়া প্রয়োজন। টেলিকম খাতের কর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা বৃদ্ধির দিকে এখন কতৃপক্ষের জোর দেওয়া দরকার।

জাতিসংঘের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাডের সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়েছে বাংলাদেশে টেলিকম খাতে বিদেশী বিনিয়োগ ধারাবাহিক ভাবে কমছে। আঙ্কটাডের তথ্য অনুসারে ২০১৪ সালে এ খাতে বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে ২২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ১ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৩২ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। এ হিসাবে এক বছরে কমেছে প্রায় ১০ কোটি ডলার।

এ ছাড়া ২০১২ সালে বিনিয়োগ ছিল ৩৭ কোটি ৪৯ লাখ ডলার।  এছাড়া জিএসএমএর ‘ডিজিটাল ইনক্লুশন ও মোবাইল সেক্টর ট্যাক্সেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক  গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ খাতে এফডিআই এসেছে ৫৮ কোটি মার্কিন ডলার, আর ২০১৪ সালে তা কমে ২৮ কোটি ডলার হয়েছে। যেখানে থ্রি জি প্রযুক্তি আশার পর টেলিকম খাত সংশ্লিষ্ট রা এবং অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন যে এই খাতে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। সেখানে এখন বিদেশী বিনিয়োগ ধারাবাহিক ভাবে কমছে। অথচ এই খাতের এখন ও অনেক সম্ভাবনা বাংলাদেশে রয়েছে। একটি সম্ভাবনাময় খাত হওয়া সত্বে ও কেন  টেলিকম শিল্প আজ হুমকির সম্মুখীন তার সঠিক কারন আজ বের করা জরুরী।

বাংলাদেশের টেলিকম অপারেটরদের জন্য এক বড় শিক্ষা আজ সিটিসেল দিয়ে গেল। এই খাতের প্রথম কোম্পানি এবং ফার্স্ট  মোভার অ্যাডভানটেজ (First mover advantages)  পাওয়ার পরে ও আজ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা , অদূরদর্শিতা এবং সময়ের সাথে খাপ না খাওয়াতে পারার কারণে আজ বাজার থেকে সিটিসেলকে বিদায় নিতে হল। সরকারের উচিত এখন সিটিসেলের কর্মী বৃন্দের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা এবং এর পাশাপাশি এই খাতে প্রতিযোগিতা বজায় রাখা। আর ন্যায্য প্রতিযোগিতা বজায় করার এখন সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে টেলিটক কে শক্তিশালী করা। পাশাপাশি গ্রাহকরা যেন টেলিকম কোম্পানি থেকে ভাল সেবা পায় সেদিকে নজর রাখা ও এখন অত্যাবশ্যকীয়। বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যাওয়ার কারনে কোন  অনৈতিক সুবিধা যেন বর্তমান কোম্পানি গুলো নিতে না পারে সেদিকে নজর রাখা দরকার।

লেখকঃ মাহামুদুল হাসান, শিক্ষক, মার্কেটিং বিভাগ,

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

tuhinjobs46@gmail.com

মন্তব্যে প্রকাশিত মত মন্তব্যকারীর নিজস্ব। www.sunbd24.com এর সম্পাদকীয় অবস্থানের সঙ্গে এসব অভিমতের মিল আছেই এমন হবার কোনো কারণ নেই। মন্তব্যকারীর বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে www.sunbd2424.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না।