রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে মিয়ানমারকে বাধ্য করুন

প্রকাশ: ২০১৬-১১-২১ ১২:৫০:৩১


rohingaমিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানকে কেন্দ্র করে আবারো চাড়া দিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার রোহিঙ্গা ইস্যু। সামরিক বাহিনীর নির্যাতন ও হত্যার শিকার গৃহহারা রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা পালিয়ে প্রায় প্রতিদিনই চেষ্টা করছে বাংলাদেশে প্রবেশের। প্রবেশ ঠেকাতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে দেশের সীমান্তে। প্রতিদিনই ফেরত পাঠানো হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। ফলে অসহায় এসব রোহিঙ্গা একদিকে যেমন না পারছে নিজ দেশে টিকতে; তেমনি শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পাচ্ছে না কোথাও। কোনো দেশই এখন পর্যন্ত এসব রোহিঙ্গাকে আশ্রয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

ঘটনাটি কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় এসব রোহিঙ্গা আগের মতো এবারো আশ্রয় নিতে চাইছে বাংলাদেশে। অথচ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এ দেশে থাকা পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে এখনো ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার। তারপরও নতুন করে রোহিঙ্গা প্রবেশের চেষ্টা বিপাকে ফেলেছে বাংলাদেশকে।

এ নিয়ে দুই দেশের নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। চলছে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েন। একদিকে সীমান্তবর্তী নাফ নদী পাড়ি দিয়ে গৃহহীন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে; অন্যদিকে মিয়ানমার সরকার সে তথ্য অস্বীকার করছে। আবার জাতিসংঘ যত না নির্যাতন বন্ধে মিয়ানমারকে চাপ দিচ্ছে; তারচেয়ে বেশি চাপে রেখেছে বাংলাদেশকে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের সীমান্ত খোলা রাখার আহ্বান জানালেও অন্য কোনো দেশকে শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আবার বাস্তবতা বিবেচনায় বাংলাদেশও নতুন করে কোনো রোহিঙ্গাকে ঢুকতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। গত কয়েকদিনে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করার সময় তিন শতাধিক রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক করেছেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা।

এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বর্তমান সরকার কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য অস্বস্তিকর বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে মিয়ানমার সীমান্তে বিশেষ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অবশ্য ২৩ ও ২৪ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় মিয়ানমারের সঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক স্থগিত করেছে বাংলাদেশ।

দেশের কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, দেশের সীমান্ত খুলে দিতে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। নইলে এর চেয়ে অনেক বেশি চাপ তারা মিয়ানমারের ওপর সৃষ্টি করত। আগেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর চাপ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ওপর যত চাপ তার সিকি ভাগও ছিল না মিয়ানমারের ওপর। দাতা দেশগুলো এ দেশে রোহিঙ্গাদের রাখতে চায় অথচ তারা যে কারণে এ দেশে চলে আসছে বা আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে, তার কোনো ধরনের প্রতিকারে আগ্রহ দেখায় না। বিশ্বের উচিত মিয়ানমারের ওপর শক্ত চাপ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করা এবং ভবিষ্যতের ব্যাপারেও সতর্ক করে দেওয়া।

একইসঙ্গে বাংলাদেশের করণীয় প্রসঙ্গে তারা বলেন, বাংলাদেশ হয়তো জরুরি অবস্থা বিবেচনায় কিছুদিনের জন্য প্রকৃত নিপীড়িতদের আশ্রয় দিতে পারে, কিন্তু সংকট কাটলে ফেরত নিতে হবে, এমন ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এটি সমাধান নয়। এরআগেও বাংলাদেশে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা এসেছে। কিন্তু তাদের ফেরত নেওয়া হয়নি। এখন তারা শুধু আর্থিক বা জনসংখ্যার দিক থেকেই বোঝা নয়; অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এ মুহূর্তে শক্তভাষায় মিয়ানমারকে এই সংকট সমাধানে উদ্যোগ নিতে বলা উচিত। একইসঙ্গে মিয়ানমারের নিজ দেশের জনগোষ্ঠীর ওপর সে দেশের সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র বিশ্ব অঙ্গনে তুলে ধরা উচিত। আন্তর্জাতিকভাবে এ অমানবিক আচরণ বন্ধে চাপ দেওয়া উচিত।

তবে মিয়ানমারের সঙ্গে তিন দশকের পুরণো রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হওয়ার জন্য বিভিন্ন সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতাকেই দায়ি করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, কোনো সরকারই জোরালোভাবে এ সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেয়নি কিংবা শক্ত ভাষায় মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করেনি। এমনকি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের অনাগ্রহের বিষয়টিও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরেনি বা আন্তর্জাতিকভাবে দেশটির ওপর চাপ সৃষ্টি করাতে পারেনি।

৯ অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সেনা অভিযান শুরু হবার জাতিসংঘের হিসেবে এখন পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। অভিযানে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের হত্যা, বাড়িঘরে আগুন এবং নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। রাখাইন রাজ্যের মংডুতে সকাল-সন্ধ্যা কারফিউ চলছে। রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় গ্রামে অন্তত নয়জন রোহিঙ্গা মুসলমানকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে। সবমিলে এ পর্যন্ত অন্তত ৬৯ জনকে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে। ফলে সেখান থেকে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশের টেকনাফে ঢোকার চেষ্টা করছে রোহিঙ্গারা।

এ সংকট সমাধানের উপায় কীজানতে প্রতিদিনের সংবাদ কথা বলে দেশের তিন বিশিষ্টজনের সঙ্গে। তারা মিয়ানমার ও বাংলাদেশ এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সার্বিক করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন।

সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর বলেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, দাতা সংস্থা বা মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে তেমন উদ্বেগ দেখায় না। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে অবৈধভাবে অবস্থানকারী কয়েক লাখ রোহিঙ্গার জীবনমান-জীবিকা নিয়েই তাদের যত উদ্বেগ। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন ছোট্ট এ দেশে কত বছর ধরে থাকবে তারা? তিন দশকেও রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে; তেমন আশার আলো দেখা যাচ্ছে না দাতা ও প্রভাবশালী দেশগুলোর দ্বৈতনীতির কারণে।

‘অথচ নতুন করে আশ্রয় দিলে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটিই হুমকির মুখে পড়বে’- উল্লেখ করে এই কূটনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, এতে দুর্ভোগ বাড়বে বাংলাদেশের। মিয়ানমারের উচিত তার দেশের ভেতর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সংখ্যালঘুদের রক্ষায় ব্যর্থ হলে প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলো সংশ্লিষ্ট সরকারকে চাপ দেয়; এমনকি জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের নজিরও আছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মিয়ানমারের ক্ষেত্রে এসবের কিছুই হয় না। মিয়ানমার নিরাপদ নয় বলে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় হতে পারে না। সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ বাড়ানো উচিত। আর তারা যদি সেটা করতে না পারে তাহলে যেন বাংলাদেশকে তার সমস্যা নিজের মতো করে সমাধানের পথ খুঁজতে দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, অতীতেও সে দেশের সরকারের নির্যাতন সইতে না পেরে রোহিঙ্গারা এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই এ ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করেনি। সংকট সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নেয়নি। ফলে এখন আবারো মিয়ানমারকে আশ্রয় দিতে চাপের মুখে পড়েছে। অথচ এখানে এসেও রোহিঙ্গারা স্বস্তিতে নেই। বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক আরো বলেন, রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে মিয়ানমারের ওপর চাপ দেওয়া উচিত। কারণ দেশটি গণতন্ত্রের কথা বলে। সেখানে গণতন্ত্রের জন্য শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন অং সাং সুচি। তিনি এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রী। সুতরাং তার দেশে এমনটি হতে পারে না। জাতিংসঘেরও উচিত অং সাং সুচিকে চাপের মুখে রাখা। এর আগে যেমন অবরোধ ছিল, তেমনি অচিরেই নিজ গোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন বন্ধ না করলে পুনরায় দেশটির ওপর অবরোধ আরোপের হুমকি দিতে হবে। কারণ দেশটি অতীতেও এমন করেছে।

‘বাংলাদেশের উচিত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চাপ সৃষ্টি করা এবং এখনই মোক্ষম সময়ং’- উল্লেখ করে এই শিক্ষক বলেন, একদিকে মিয়ানমার ইতোমধ্যেই আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের এ দেশ থেকে নিচ্ছে না, তারওপর নতুন করে বের করে দিচ্ছে। সুতরাং সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগের এখন সুযোগ। মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশ প্রকৃত নির্যাতিতদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আশ্রয় দিতে পারে, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যাতে স্থায়ীভাবে আগের মতো থেকে না যায়। তবে এটা কোনো সমাধান নয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের শক্ত অবস্থান নেওয়া উচিত। আন্তর্জাতিকভাবে তিন দশকের পুরনো রোহিঙ্গা ইস্যুটি তুলে ধরতে হবে। সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষ করে নাগরিকদের ওপর কোনো দেশ এমন করে নির্যাতন করতে পারে না। এভাবে চলতে পারে না।

অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, এ দফায় বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দিলেও লাভ নেই। অতীতেও খুলে দেওয়া হয়েছিল এবং রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশটির চরিত্র বদলায়নি। নতুন করে যেন আর না আসে সে ব্যাপারে মিয়ানমারকে চাপের মধ্যে রাখতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও রোহিঙ্গা গবেষক জাকির হোসেন বলেন, প্রথমেই বাংলাদেশের উচিত বিশ্ব অঙ্গনে মিয়ানমার সরকারের সে দেশের নাগরিকদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা। মূলত ১৪৪টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সে দেশের নাগরিক ছিল। কিন্তু ১৯৮২ সালে নয়টি জাতিগোষ্ঠীকে অস্বীকার করা হয় ও তাদের নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। মূলত এরা সবাই মুসলমান ধর্মের অনুসারী। এদের মধ্যে রোহিঙ্গাই বেশি। ফলে তারা বিপদে পড়ে। সেখানে এখন তাদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। জন্ম-মৃত্যুর জন্য ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে অনুমতি নিতে হচ্ছে। বিয়ে করতে পারছে না। এ চিত্রটি তুলে ধরা উচিত।

জাকির হোসেন আরো বলেন, জাতিসংঘ বলছে বাংলাদেশে ২৯ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। কিন্তু আমাদের গবেষণা বলছে, এ সংখ্যা ৪-৫ লাখ। মানবতার কারণে হয়তো এবারো তাদের আশ্রয় দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে? ৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনবার রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আর কত? এটি বন্ধ হওয়া উচিত বাস্তবতার কারণেই। রোহিঙ্গা শুধু এখন আর আর্থিক বা জনসংখ্যা সম্পর্কিত সমস্যাই নয়; তারা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘যেহেতু চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ভালো সম্পর্ক। তাই বাংলাদেশ চীনকে দিয়ে মিয়ানমারের ওপর রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। বাংলাদেশেরও উচিত আন্তর্জাতিক আদালতে বিষয়টি তোলা’—যোগ করেন এই গবেষক।