আ.লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের তিন বছর পূর্তি
আপডেট: ২০১৭-০১-১২ ১১:৫৮:২৫
নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও সাফল্যের মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদের তিন বছর পার করল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনে জিতে পুনরায় সরকার গঠন করে ১৪ দলীয় জোট। ১২ জানুয়ারি জোট সরকার শপথ গ্রহণ করে।
সরকারের তিন বছর পূর্তিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
গত ৪ জানুয়ারি বুধবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসবভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ এবং উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, জনগণ পুনরায় আওয়ামী লীগকে সুযোগ দিয়েছে বলেই আমরা উন্নয়নের গতি এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছি। এখন দেশের উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়েছে। মানুষ তার সুফল ভোগ করছে। এই তিন বছর আমরা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করেছি। দেশের উন্নতি হয়েছে। আমরা যে উন্নয়নের কাজ শুরু করেছিলাম, জনগণ আমাদের ভোট দিয়ে পুনরায় নির্বাচিত করে সেই উন্নয়নের কাজের গতিটা ধরে রাখতে সুযোগ দিয়েছে। মানুষ তার সুফল ভোগ করছে। মানুষ আজ অনেক সুখে শান্তিতে আছে।
সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের সুবিধাপ্রাপ্তির উদাহরণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এত সফলভাবে কোনো সরকার দেশ চালাতে পারেনি। যেটা আমরা করতে পেরেছি। দেশ আজকে আন্তর্জাতিক উন্নয়নের রোল মডেল। বিশ্বের কাছে বিস্ময়।
সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এক বছরের ব্যবধানে ৫৮তম স্থান থেকে ১৪ ধাপ এগিয়ে এখন ৪৪তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয় ২০০৫-০৬ সালের ৫৪৩ ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৬ সালে ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭১ বছরে উন্নীত হয়েছে। গত ছয় বছরে গড় প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশ। এ বছর ৭.০৫ শতাংশ হবে। আগামী বছরের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে গড় মুদ্রাস্ফীতি ৬ শতাংশ। এপ্রিল মাসে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৫.৬১ শতাংশ। এখন মূল্যস্ফীতি ১০ বছরে মধ্যে সর্বনিম্ন- মাত্র ৫.৪৫ শতাংশ। বর্তমানে রিজার্ভের পরিমাণ ৩১.০২ বিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্র ১০০টির ওপরে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এখন প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট। ৭৮ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে এবং রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভূমি উন্নয়নের কাজ শেষ পর্যায়ে। মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হয়েছে। এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের কাজ চলছে। আগামী ২০২১ সালের আগেই ১০০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় আসবে বলে সরকার সংশ্লিষ্টরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হয়ে সরকার শত বাধা ও চাপ উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। ইতিমধ্যে কাদের মোল্লার পর কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামান, সাকা চৌধুরী, মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী, আবুল কাশেমের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
ক্ষমতাসীন সরকার যোগাযোগ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। কিছু কাজ চলমান রয়েছে। সরকারের মেগা প্রকল্প মেট্রোরেল নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। নবীনগর-ডিইপিজেড-চন্দ্রা সড়ক এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। শিগগিরই চালু হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন। পায়রা সমুদ্র বন্দর চালু করা হয়েছে। ঢাকা-মাওয়া সড়কে প্রথমবারের মতো আট লেনের মহাসড়ক চালু করা হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের মধ্যে সেতুতে যান চলাচল করবে। দ্বিতীয় কাঁচপুর, দ্বিতীয় মেঘনা এবং দ্বিতীয় গোমতি সেতু নির্মাণের কাজ শিগগিরই শুরু হবে। রেলের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতেও সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন করেছে। ইতিমধ্যে ১৬ হাজার ৪৩৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। বিনামূল্যে ৩০ পদের ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। নার্সের পদমর্যাদা তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে নতুন দুটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ২০০৬ সালে ছিল জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১.৪৯ শতাংশ। বর্তমানে তা ১.২৭ শতাংশ। মাতৃমৃত্যু প্রতি হাজারে ১.৭ এবং শিশুমৃত্যু ৩০ জনে নেমে এসেছে।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। চা-শ্রমিকদের জন্য জন্য অনুদান ১০ কোটি থেকে বৃদ্ধি করে ১৫ কোটি করা হয়েছে। আশ্রয়ণ, একটি বাড়ি একটি খামার, ঘরে ফেরা কার্যক্রম, দুস্থ ভাতাসহ ১৪৫টি সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সুবিধা পাচ্ছেন। সম্প্রতি ১০০টি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক উদ্বোধন করা হয়েছে। বর্তমানে মোবাইল সিম কার্ডের সংখ্যা ১৩ কোটি। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি ২০ লাখের বেশি।
প্রযুক্তি খাতে উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হবে। গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে এবং যশোরে হাই-টেক পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। বিভাগীয় শহরে সিলিকন সিটি স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। ২৫ হাজার ওয়েবসাইট নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েবপোর্টাল তথ্য বাতায়ন খোলা হয়েছে।
কৃষি খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। সারা দেশে ২৪৫টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্রে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগাযোগের জন্য মোবাইল অ্যাপ ‘আলাপন’ চালু করা হয়েছে। ইন্টারনেট জগতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ডোমেইন (ইন্টারন্যাশনালাইড ডোমেইন নেম বা আইডিএন) ‘ডট বাংলা’ ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ পেয়েছে বাংলাদেশ। ইন্টারনেটে একটি রাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয়ের স্বীকৃতি হিসেবে কাজ করে এই ডোমেইন। দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ নির্মাণ সম্পন্ন। এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে।
বছরের ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের মাঝে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭২২টি পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে।
কৃষি খাতেও দৃশ্যমান সাফল্য অর্জন করেছে দেশ। বাংলাদেশ এখন আম উৎপাদনে বিশ্বে নবম এবং আলু উৎপাদনে অষ্টম স্থানে। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম দেশ হিসেবে স্বীকৃত।
আওয়ামী লীগ সরকার সবসময়ই ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে সবচেয়ে উদার নীতি গ্রহণ করে আসছে। সরকারি কর্মচারীদের পে-স্কেল দিয়ে বেতন-ভাতা প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারই প্রথম তাদের বেতন-ভাতা ১২৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে। শেখ হাসিনার উদ্যোগে বাংলা নববর্ষে উৎসব ভাতা চালু করা হয়েছে। পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদকে তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এবং ইন্সপেক্টর পদকে দ্বিতীয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি ও সশস্ত্র বাহিনীর ঝুঁকি ভাতা বাড়ানো হয়েছে।
জাতির পিতা প্রণীত ১৯৭৪ সালের প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে আর্মড ফোর্সেস গোল-২০৩০ নির্ধারণ করেছে। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ঘোষণা করেছে।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ আইএমএসও, আইটিইউ এবং হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলসহ ১২টি আন্তর্জাতিক সংস্থার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। ইউনেস্কো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘শান্তির বৃক্ষ’পুরস্কারে ভূষিত করেছে। জাতিসংঘ সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন দপ্তর এবং অরগানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভিশনারি অ্যাওয়ার্ড-২০১৪ প্রদান করেছে। বাংলাদেশ এমডিজি ১ থেকে ৪ অর্জন করেছে। বাংলাদেশ এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড এবং আইটিইউর ‘ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি’পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। পরিবেশ উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ পুরস্কারে ভূষিত করেছে। ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর লিঙ্গসমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ও ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’পুরস্কার প্রদান করে জাতিসংঘ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বে রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। বিশ্বে শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে এবার বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। ভারতের সঙ্গে স্থলসীমানা চুক্তির বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ৫২ হাজার ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের প্রতীক্ষার অবসান করে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার শান্তিপূর্ণ সমাধানের মাধ্যমে বিশাল সমুদ্রে অঞ্চলে বাংলাদেশে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার টেরিটোরিয়াল এলাকায় বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে।
২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে জঙ্গিভীতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।