সার্চ কমিটি নিরপেক্ষ হয়নি: বিএনপি
প্রকাশ: ২০১৭-০১-২৭ ১৪:২১:২৫
রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠনের দুদিন পর শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। “এই কমিটিকে নির্দলীয় কিংবা নিরপেক্ষ বিবেচনার করার কোনো অবকাশ নেই”- একথা বলার পর তার কাছে এক সাংবাদিক প্রশ্ন রাখেন, “তাহলে কি সার্চ কমিটি আপনারা প্রত্যাখ্যান করছেন?” উত্তরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “এখানে প্রত্যাখ্যান করা বা না করার কোনো বিষয় নেই। নির্বাচন কমিশন যখন গঠিত হবে, তখন এই প্রশ্ন আসতে পারে। আমরা সার্চ কমিটির বিষয়ে আমাদের মতামত বা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি।”
বিএনপিসহ সক্রিয় অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের পর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত বৃহস্পতিবার নতুন ইসি নিয়োগের জন্য সম্ভাব্য ব্যক্তিদের বাছাই করতে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে। আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান করে গঠিত এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, পিএসসি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, সিএজি মাসুদ আহমেদ, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও অধ্যাপক শিরীণ আখতার।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়ে সার্চ কমিটি গঠনের সুপারিশ করে আসা বিএনপির নেতারা শুরু থেকেই এই সার্চ কমিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছেন। শনিবার দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানালেন মহাসচিব ফখরুল।
রাষ্ট্রপতি গঠিত এই সার্চ কমিটি নিয়ে সরকারেরই সমালোচনা করছে বিএনপি, যদিও এর গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে আসছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা। ফখরুল বলেন, “এমন সব ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত এই কমিটিকে নির্দলীয় কিংবা নিরপেক্ষ বিবেচনার করার কোনোই অবকাশ নেই।
“আমরা প্রার্থীহীন, ভোটারহীন নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন সরকারের এই স্বৈরাচারী আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।” এই সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা সম্ভবপর হবে না বলে মনে করেন বিএনপি মহাসচিব।
“আমরা মনে করি, এমন একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, সৎ, সাহসী ও যোগ্য ব্যক্তিগণ আগামী নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান কিংবা সদস্য হবেন, এমনটা আশা করারও বাতুলতা মাত্র।” “আমরা এই ঘটনার মাধ্যমে আগামী নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সরকারি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশবাসীকে হুঁশিয়ারি হতে এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানাচ্ছি,” বলেন তিনি। সার্চ কমিটি পুনর্গঠনের কোনো আবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে করবেন কি না- প্রশ্ন করা হলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “না, আমরা কোনো আবেদন করব না।”
গঠিত সার্চ কমিটির ছয় সদস্যের মধ্যে পাঁচজনেরই নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। ফখরুল বলেন, “এই কমিটিতে ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছাপূরণে সহযোগিতায় পুরস্কৃত এবং আওয়ামী পরিবারের বিশ্বস্ত সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি শুধু একে বিতর্কিতই করেনি, এর মাধ্যমে জনমতকে অগ্রাহ্য করার আরেকটি অগণতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে।”
সার্চ কমিটির প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে নিয়ে তিনি বলেন, “তিনি ২০১২ সালে গঠিত সার্চ কমিটিরও প্রধান ছিলেন। যে কমিটির প্রস্তাবক্রমে রকিবউদ্দীন কমিশনের মতো একটি অযোগ্য, অনুগত, মেরুদণ্ডহীন ও বিতর্কিত কমিশন নিযুক্ত হয়। সেই কমিটির প্রধানকেই নতুন সার্চ কমিটির প্রধান করার অর্থ হল, সরকার রকিবউদ্দীন কমিশনের মতোই আরেকটা অনুগত ও অযোগ্য নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করতে চায়।”
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের (বাকশালের ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগ) কেন্দ্রীয় নেতা এবং ওকালতি জীবনে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন বলে জানান ফখরুল। “তার পিতা ডা. আখলাকুল হোসাইন ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। তার ছোট ভাই এখন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।”
পিএসসি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিকের ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় ইসি সচিবের দায়িত্বে থাকার কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব, যে নির্বাচন তারা বর্জন করেছিলেন। “নানা অনিয়মের ভরা ওই নির্বাচনকে নিয়মসিদ্ধ করার পুরস্কার হিসেবে অবসর গ্রহণের পর তাকে রাজনৈতিক বিবেচনায় চুক্তি ভিত্তিতে পিএসসির চেয়ারম্যান করা হয়েছে। অনুগ্রহভাজন এবং সহকর্মীদের কাছে আওয়ামী ঘরানার সক্রিয় সমর্থক হিসেবে পরিচিত এই আমলা সরকারের ইচ্ছাপুরণে সচেষ্টা থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক।”
সার্চ কমিটির একমাত্র নারী সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য্ অধ্যাপক শিরীণ আখতারের পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগ সম্পৃক্ততার কথা বলেন ফখরুল।
“চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী পন্থি শিক্ষক হিসেবে ২০১৪ সালের শিক্ষক সমিতির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তার পিতা মরহুম আফসার কামাল চৌধুরী কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি নিজেও কক্সবাজার মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী ছিলেন।”
সিএজি মাসুদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকলেও একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে তিনি সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবেন না বলে মনে করেন ফখরুল। সার্চ কমিটির বাকি সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বিষয়ে কোনো আপত্তি তোলেনি বিএনপি।
অবসরপ্রাপ্তদের দিয়ে সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাবের যৌক্তিকতা তুলে ধরে ফখরুল বলেন, “এর উদ্দেশ্য ছিল যে, সার্চ কমিটির কোনো সদস্য সরকারের অধীনস্থ হবেন না, দায়বদ্ধ থাকবেন না, অনুগ্রহভাজন হবে না এবং স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।”
সার্চ কমিটি বিতর্কিত করলে ‘বিএনপিরই ক্ষতি হবে’ বলে যে হুঁশিয়ারি আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ দিয়েছেন, তার প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল।
দুই প্রধান দলের সমঝোতায় কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রসঙ্গ বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমরা জাতিসংঘের যে কোনো উদ্যোগকে সমর্থন করছি, আগেও করেছিলাম। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, জাতিসংঘ যে উদ্যোগ নেয়, এই সরকার তার আশ-পাশ দিয়েও যায় না। তাদেরকে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করতেও বাধা প্রদান করেন।”
নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সংবাদ সম্মেলনে ফখরুলের সঙ্গে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, এজেডএম জাহিদ হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।