ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার সার্বজনীন প্রচলন
প্রকাশ: ২০১৭-০২-২৩ ১৭:১২:৪১
১৯৫২ সালে পৃথিবীতে ভাষার জন্য জীবন দানকারী জাতি হল বাঙালী জাতি। শুধুমাত্র ভাষার জন্য রক্তঝড়া বিশ্বে বিরল ঘটনা। এই মুখের ভাষা বাংলাকে কেড়ে নেওয়ার জন্য পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাঙালীর উপর নির্যাতন, নিপীড়ন, নানাবিদও ষড়যন্ত্র করে। তবুও তারা বাঙালীর মুখের ভাষা বাংলাকে কেড়ে নিতে পারেনি। এ দেশের ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক ও পেশাজীবীরা সকল ষড়যন্ত্র ভেদ করে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদায় আসীন করে।
এই ১৯৫২ সালের ভাষা ভিত্তিক চেতনা করে ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে বিজয় লাভ করে যুক্তফ্রন্ট সরকার। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে, ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ সালে জন মানুষের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় লাভ ঘটে।
কিন্তু গণরায়ে আওয়ামীলীগ জয়লাভ করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালী জাতির রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতির মুক্তির সংগ্রাম ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। মাত্র ০৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ ২ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা।
বাঙালী জাতির স্বাধীনতা অর্জনের মূলভিত্তি মূলত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার এত বছর পরেও যে ভাষার জন্য বাঙালীর এত রক্তক্ষয়, সেই বাংলা ভাষা আজও সর্বস্তরে সমভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। তন্মধ্যে অন্যতম হল ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত। বৈশ্বিক ভাষা হিসেবে ইংরেজীর গুরুত্ব থাকলেও, এ দেশের অর্থনৈতিক লেনদেন জড়িত তথ ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে কাজ করে শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত, অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী।
ফলশ্রুতিতে যে সমস্ত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করে তাদের গ্রাহকেরা ব্যাংক ও বীমা তাদের কি সুবিধার জন্য কি মাশুল বা জরিমানা প্রদান করে তা তারা বুঝতে পারে না। যে কারণে গ্রাহকরা তাদের নিজের অজান্তেয় অনেক ক্ষেত্রে প্রতারনার স্বীকার হচ্ছে শুধু তাদের ভাষা জ্ঞানের অভাবে। বিশেষত ব্যাংকিং খাতে আমানতকারীরা কি কি শর্তের বিনিময়ে তারা ব্যাংকের কি কি সুবিধা লাভ করবে আমানতকারীদের ফর্মে সমস্ত শর্তাবলী লেখা থাকলেও ভাষা জ্ঞানের অদক্ষতার কারণে আমানতাকরীরা সে সমস্ত সুবিধা বা তাদের অধিকার যথাযথ ভাবে ভোগ করতে পারে না।
ফলে আর্থিক ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে আমানতকারীরা। অনুরূপভাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে ভাষা সমস্যা। ঋণের সমস্ত শর্তাবলী বা দলিলায়ন সম্পাদিত হয় ইংরেজী ভাষায়। ইংরেজীতে দলিলায়ন সম্পাদিত হওয়ায় অধিকাংশ ঋণ গ্রহীতা বুঝতে পারে না কি কি শর্তের বিনিময়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কে কি মাশুল ও জরিমানা দিতে হবে। ফলে ঋণ গ্রহীতার আগোছরে ঢুকে পড়ছে ঋণ পরিশোধের নানা গোপন মাশুল।
যা ঋণ গ্রহীতা বুঝতেও পারছে না। অনেক সময় দেখা যায় ঋণ নিয়ে মামলা মোকদ্দমা হলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ আদালতের নজরে এমন সব শর্তাবলী নজরে নিয়ে আসেন যা ঋণ গ্রহীতা পূর্বে অনুধাবন করতে পারেনি শুধু যথাযথ ভাষা জ্ঞান তথা ইংরেজীতে ঋণের দলিলায়ন সম্পাদিত হওয়ার কারণে। যার ফলে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ঋণ গ্রহীতারা। ব্যাংকও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুরূপ সরকারী বীমা ব্যতীত অধিকাংশ বীমা কোম্পানীগুলো তাদের বীমা পলিসির শর্তাবলী ইংরেজী ভাষায় সাধারণ জনগনের ভাষা জ্ঞানের সরলতার সুযোগে বীমা কোম্পানীগুলো তাদের কোম্পানীর স্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে লাভ করলেও সাধারণ জনগন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বিদেশী ভাষাব্যবহার করার কারণে।
সুতরাং সাধারণ জনগনকে আর্থিক ক্ষতি থেকে রেহাই এবং বাংলা ভাষার মর্যাদার রক্ষার স্বার্থে সরকারী বেসরকারী ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহে বাংলা ভাষায় অফিসিয়াল ভাবে চালু করা অতীব জরুরী। তবে আশার কথা এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ও বীমা। জানা যায় সরকারী ব্যাংক ও বীমার সমস্ত অফিসিয়াল কর্মকান্ড চলে বাংলা ভাষায়। কর্মকর্তা/কর্মচারীরা বাংলা ভাষায় কে কতটা দক্ষ তার জন্য তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এ.সি.আর) মার্কের ব্যবস্থা আছে। আমরা মনে করি বহু কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে বিশেষ করে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রচলনের জন্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বীমা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জোড়ালো দাবী জানাচ্ছি।
লেখক:
এম.ফিল গবেষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়