কিছু ট্যানারি সরছে, বেশির ভাগ চলছে
প্রকাশ: ২০১৭-০৩-১১ ১৬:৪৯:২০
বেশির ভাগ ট্যানারিতে উৎপাদন কার্যক্রম চলছে, কিছু ট্যানারিতে প্রক্রিয়াজাত করার জন্য কাঁচা চামড়া মজুত করেও রাখা হয়েছে, কিছু ট্যানারি যন্ত্রপাতি খুলে সাভারের চামড়াশিল্প নগরে নিয়ে যাচ্ছে—রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারি এলাকার এখনকার চিত্র এটি। অথচ কথা ছিল জানুয়ারির মধ্যে সব ট্যানারি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার প্রথম ধাপ ওয়েট ব্লু অংশ সাভারে নিয়ে যাবে, আর পুরো ট্যানারি সরিয়ে নেবে চলতি মার্চের মধ্যে।
অবশ্য এরই মধ্যে হাইকোর্টের একটি রায় এসেছে, যাতে বলা হয়েছে অবিলম্বে হাজারীবাগে থাকা ট্যানারিগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। তাদের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগও কেটে দিতে বলেছেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে ৬ এপ্রিলের মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরকে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে আদালতে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ সময়ের মধ্যে ট্যানারিগুলো সাভারে নেওয়া সম্ভব নয়। তবে গত এক মাসে হাজারীবাগে একটি পরিবর্তন এসেছে, সেটি হলো—বড় বড় কিছু ট্যানারি তাদের ওয়েট ব্লু অংশ হয় বন্ধ করে দিয়েছে, না হয় সরিয়ে সাভারে নিয়ে গেছে।
পরিবেশদূষণ রোধে হাজারীবাগের মোট ১৫৪টি ট্যানারি সরিয়ে নিতে সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরা গ্রামে প্রায় ১৯৯ একর জমিতে চামড়াশিল্প নগর গড়ে তুলছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এ জন্য ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। যদিও এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি।
অন্যদিকে সাভারে ট্যানারি মালিকদের প্রস্তুতি আরও কম। চামড়াশিল্প নগর কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সাভারে চামড়া ওয়েট ব্লু করার জন্য ড্রাম বসাতে পেরেছে অর্ধশতাধিক কারখানা। আর ওয়েট ব্লু করা শুরু করেছে ৪৩টি ট্যানারি।
হাইকোর্টের নির্দেশের পর পরিবেশ অধিদপ্তর এখন নির্দেশনার সত্যায়িত বা সার্টিফায়েড কপি পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। অধিদপ্তরের পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) ম. আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, নির্দেশে কী বলা আছে তা দেখেই বাস্তবায়ন শুরু হবে। এ জন্য প্রস্তুতি নেওয়া আছে।
এদিকে শিল্প মন্ত্রণালয় গত বুধবার চিঠি দিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে। অন্যদিকে হাজারীবাগে যাতে কাঁচা চামড়া প্রবেশ করতে না পারে, সে বিষয়ে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। তবে ট্যানারি মালিকেরা বলছেন, তাঁরাও রায়ের সত্যায়িত বা সার্টিফায়েড কপি পেলে আপিল করবেন। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপিল করার জন্য সময়টুকু আমাদের দেওয়া উচিত।’
কাঁচা চামড়া ট্যানারিতে নেওয়ার পর সেটিকে ওয়েট ব্লু করতে সবচেয়ে বেশি রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। ট্যানারি মালিকদের দাবি, ৭৫ শতাংশ দূষণের জন্য দায়ী ওয়েট ব্লু। চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের বাকি দুই ধাপে (ক্রাস্ট ও ফিনিশড) রাসায়নিকের ব্যবহার কম। তারা এখন ওয়েট ব্লু অংশ সরিয়ে নিতেই কাজ করছেন।
হাজারীবাগে যেসব কারখানা এখনো ওয়েট ব্লু করছে তার একটি হলো গ্রেট ইস্টার্ন ট্যানারি। এই ট্যানারিটিতে গত বুধবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায় লবণ দেওয়া কাঁচা চামড়া স্তূপ করে রাখা। এক পাশে ড্রামে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ চলছে। কয়েক জন শ্রমিক কাজ করছেন। এ ট্যানারির পাশেই আরেকটি ট্যানারি হলো এমআই ট্যানারি। সেটিতেও কাঁচা চামড়া স্তূপ করে রাখা। শ্রমিকেরা জানান, ট্যানারিটি মূলত ভাড়ায় চলে। অর্থাৎ রপ্তানিকারকেরা চামড়া কিনে এনে সেখান থেকে প্রক্রিয়াজাত করিয়ে রপ্তানি করেন। ভেতরে ঢুকতে গেলে একজন রপ্তানিকারক এসে বলেন, এমআই ট্যানারি সাভারে জমি পায়নি। মালিকপক্ষের কেউ নেই। তাই কথা বলা যাবে না।
কথা বলতে রাজি হয়নি লেক্সকো লিমিটেড নামের একটি ট্যানারিও। ভেতরে ঢুকে ব্যবস্থাপকের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বেশ কিছু সময় অপেক্ষার পর নিরাপত্তাকর্মীরা এসে জানান, ব্যবস্থাপক ব্যস্ত। তবে বেলা একটা বাজতেই শ্রমিকেরা ট্যানারিটি থেকে সারি বেঁধে বেরিয়ে আসেন। জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, সেখানে পুরোদমে উৎপাদন চলছে। ফিনিক্স লেদার কমপ্লেক্সের কর্মীরা জানান, গত মঙ্গলবার থেকে ওই ট্যানারিতে ওয়েট ব্লু উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে ক্রাস্ট ও ফিনিশড উৎপাদন চলছে।
হাজারীবাগের একটি মাঝারি আকারের ট্যানারির নাম রুমা লেদার। সেই ট্যানারিতে ড্রাম সরিয়ে নেওয়ার জন্য কাঠামো ভাঙা হয়েছে। উৎপাদন বন্ধ। রুমা ট্যানারির সামনেই আইয়ুব ব্রাদার্স ট্যানারি। সেটি বড় একটি যন্ত্র খুলে সাভারে নিচ্ছিল। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানি শাখার কর্মকর্তা শামসুল আলম বলেন, ওয়েট ব্লুর পুরো প্রক্রিয়া তাঁরা সাভারে সরিয়ে নিয়েছেন।
সার্বিকভাবে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোর অবস্থা কী জানতে চাইলে একটি বড় ট্যানারির মালিক প্রথম আলোকে বলেন, হাজারীবাগে এখন কাঁচা চামড়া খুব কম প্রবেশ করছে। এর একটা কারণ বড় ট্যানারিগুলো ওয়েট ব্লু করা বন্ধ করেছে। আরেকটি কারণ হলো, এখন কাঁচা চামড়ার সরবরাহ কম। তিনি বলেন, সরকার ট্যানারিগুলোর ওয়েট ব্লু অংশ বন্ধ করে দিলে চামড়া খাতের ক্ষতি হবে না। তবে পুরো ট্যানারি বন্ধ করে দিলে এ খাতের রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, সাভারে এখনো ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া উৎপাদনের প্রস্তুতি নেই। সরকারও সেখানে গ্যাস–সংযোগ দেওয়া শুরু করেনি। গ্যাস ছাড়া ক্রাস্ট ও ফিনিশড অংশ চালু করা সম্ভব নয়।
সাভারে যেতে সমস্যা কী—এ প্রশ্নের উত্তরে ট্যানারি মালিকেরা একমাত্র কারণ হিসেবে অর্থসংকটের কথা বলছেন। বড় ট্যানারিগুলোর একটি ঢাকা হাইড অ্যান্ড স্কিনের পরিচালক এ জে খোকন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের মোট ২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে। সরকার সাভারের জমির মালিকানা বুঝিয়ে দিলে তা ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া যেত। তিনি বলেন, তাঁদের ট্যানারি সাভারে উৎপাদন শুরু করেছে। বাকি যন্ত্রপাতি খুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
এইচএস ট্যানারি নামের একটি ছোট ট্যানারির মালিক হাফেজ আহমেদ বলেন, সাভারে পাওয়া ১০ হাজার বর্গফুট জমিতে ভবন করার জন্য তিনি নিজের একটি বাড়ি বিক্রি করেছেন। এখন আর তাঁর কাছে টাকা নেই। জরিমানার বিষয়ে বলেন, ‘ধারকর্জ করে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়েছি। আর দিতে পারি নাই। এখন আদালত জেলে পুরে দিলে সেখানে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাব।’
গত জুলাইয়ে আপিল বিভাগ হাজারীবাগ ছাড়তে ব্যর্থ ট্যানারিগুলোকে দৈনিক ১০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ বাবদ জরিমানা করেন। ২ মার্চ বকেয়া ৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিশোধ করতে ট্যানারি মালিকদের নির্দেশ দেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।
সানবিডি/ঢাকা/মেহেদী/এসএস