আতিয়া মহলের বাসিন্দাদের দুঃসহ দিনযাপন
প্রকাশ: ২০১৭-০৪-০২ ১০:৩১:১০
বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙ্গেছিল আতিয়া মহলের বাসিন্দাদের। বাইরের যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠেছিল সবার। পুলিশের আহবানে নিজ নিজ ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ করে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন তারা। পরদিন, সেনা কমান্ডোদের দুঃসাহসিক অভিযানে মুক্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন আতিয়া মহলের ৭৮ নিরীহ বাসিন্দা। কিন্তু এক কাপড়েই ঘর থেকে জীবন নিয়ে একরকম পালিয়ে বাঁচতে হয়েছিল তাদের। এরপর এখানে-সেখানে কোনরকমে দিনযাপন করছেন সেসব বাসিন্দারা। আতিয়া মহল এখনও পুলিশের জিম্মায় থাকায় সেখানে গিয়ে উঠতে পারছেন না ২৮টি ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা।
গত ২৩ মার্চ দিবাগত রাত থেকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পাঠানপাড়াস্থ আতিয়া মহল ঘিরে শুরু হয় পুলিশের অভিযান। পরদিন সকাল থেকে সাজ সাজ রব পড়ে শিববাড়ি ঘিরে। পুলিশ, র্যাব, ডিবি, এসবি, পিবিআইসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঢল নামে আতিয়া মহলকে কেন্দ্র করে। বিকেলে যোগ দেয় সোয়াত। রাতে ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করে যায় সেনাবাহিনীর একটি দল। এর পরদিন থেকে শুরু হয় সেনা কমান্ডোদের ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’।
আতিয়া মহলে অভিযান শুরুর পরদিন ২৪ মার্চ ভোর রাতে বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে ওই ভবনের বাসিন্দারা ভবনের নিচে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখতে পান। ভয়ানক কিছু ঘটেছে, আঁচ করে নেন তারা। পরে পুলিশের হ্যান্ড মাইকের আহবানে জঙ্গি আস্তানা থাকার বিষয়টি বুঝতে পারেন আতিয়া মহলের বাসিন্দারা। পুলিশ তাদের বাইরে বেরোতে নিষেধ করে; দরজা-জানালা বন্ধ করে থাকার আহবান জানায়।
এরপর পেরিয়ে যায় দীর্ঘ সময়। পরদিন ২৫ মার্চ সেনা কমান্ডোরা তাদের অভিযানের শুরুতেই আতিয়া মহলে আটকাপড়া ২৮টি ফ্ল্যাটের ৭৮ বাসিন্দাদের উদ্ধার কাজ শুরু করেন। জীবন বাজি রেখে সেনা কমান্ডোরা পার্শ্বস্থ চার তলা ভবনের গায়ে মই লাগিয়ে পাঁচ তলা আতিয়া মহল থেকে এসব বাসিন্দাদের নিরাপদে বের করে নেন। তবে ওই বাসিন্দারা এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। এরপর সাত দিন পেরিয়ে গেছে, কিন্তু ওই ভবনে ঢোকার সুযোগ আর হয়নি ওইসব বাসিন্দার।
আতিয়া মহলের চারতলার একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম। জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময় স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে বাসার ভেতর আটকা পড়েন তিনি। সেনা কমান্ডোরা উদ্ধার করে নিয়ে আসেন তদের। এক কাপড় গায়ে দিয়ে বের হন সবাই। বাসা থেকে নিয়ে আসতে পারেননি জরুরি কাগজপত্র, টাকাপয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র। আতিয়া মহল থেকে উদ্ধার হওয়ার পর প্রথমে একটি হোটেল রাতযাপন করেন তিনি। পরে ওঠেছেন এক সহকর্মীর বাসায়। বইপত্র ও কাপড়চোপড় আতিয়া মহলের ভেতরে রয়ে যাওয়ায় স্কুলে যেতে পারছেন না তার দুই মেয়ে।
রবিউল ইসলাম বলেন, আতিয়া মহল ঘেরাও করে রাখার পর ভেতরে আটকা পড়ি আমরা। পরে কমান্ডোরা উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। এক কাপড়ে স্ত্রী-বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে আসি ঘর ছেড়ে। প্রথমে হোটেলে ওঠি, পরে এক বন্ধুর বাড়িতে ওঠেছি।
রবিউলের স্ত্রী নিপা বেগম বলেন, নতুন জীবন পেয়েছি। পুলিশ ও সেনা সদস্যদের ধন্যবাদ। আমার পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে তান্নি ও ৪র্থ শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে তারিন স্কুলে যেতে পারছে না। তাদের বইপত্র সব আতিয়া মহলে রয়ে গেছে। সামনে পরীক্ষা, স্কুলে যেতে না পেরে কান্নাকাটি করে তারা। সঙ্গে কিছু আনতে না পারায় একপ্রকার মানবেতর জীবনযাপন করছি আমরা।
আতিয়া মহলে অভিযানের দিন থেকেই বন্ধ রয়েছে পার্শ্বস্থ জহির তাহির মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়। সামনে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা। কিন্তু বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া সামিউল আলম ও ষষ্ঠ শ্রেণী পড়ুয়া আবুল কালাম বলে, সামনে আমাদের পরীক্ষা। কিন্তু আমরা স্কুলে যেতে পারছি না। পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়ছি।
এদিকে, শিববাড়ি এলাকায় যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করায় কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে স্থানীয়দের মাঝে। খুলতে শুরু করেছে এলাকার দোকানপাট। তবে আতিয়া মহলের ভেতরে এখনো দুই জঙ্গির লাশ ও বিস্ফোরক থাকায় আতঙ্কিত তারা। স্থানীয় ব্যবসায়ী বদরুল হোসেন বলেন, আমাদের মাঝে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে। তবে আতিয়ার ভেতরে দুই জঙ্গির লাশ পচে দুর্গন্ধ ছড়ানোয় এবং ভেতরে বিস্ফোরক থাকায় এখনও আমাদের মাঝে আতঙ্ক রয়েছে।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার জেদান আল মুসা বলেন, সেনাবাহিনীর বোমা ডিসপোজাল ইউনিট দু’একদিনের মধ্যে আতিয়া মহলকে বিস্ফোরকমুক্ত করার কাজ শুরু করবে। বিস্ফোরকমুক্ত হলেই আতিয়া মহল খুলে দেওয়া হবে। এর আগ পর্যন্ত সবাইকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।