অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের নাক গলানো নিয়ে বিতর্ক

প্রকাশ: ২০১৭-০৪-০৩ ১০:০৯:০৯


IPUকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের নাক গলানো বন্ধে সংসদের ভূমিকা নিয়ে অনুষ্ঠিত দীর্ঘ বিতর্কে অংশ নেয়া প্রায় ৪০ দেশের মধ্যে ৩৫টি দেশই অন্য দেশের হস্তক্ষেপ বন্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তিন দিনের আলোচনা শেষে আগামীকাল ভোটাভুটির মাধ্যমে রেজুলেশন গৃহীত হবে।
গতকাল রোববার ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬তম অ্যাসেম্বলির দ্বিতীয় দিনে ‘পিস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি’ (শান্তি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা) শীর্ষক অ্যাসেম্বলিতে উন্নয়নশীল দেশগুলো অন্য দেশে হস্তক্ষেপ বন্ধের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়ে বলেছে, শুধু বিশেষ পরিস্থিতিতে যদি খুব প্রয়োজন পড়ে তবে জাতিসংঘের ম্যান্ডেট নিয়ে হস্তক্ষেপ করা করা যেতে পারে। অন্যদিকে জার্মানিসহ চারটি উন্নত দেশের জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টিতে সংশোধনী আনার দাবি জানিয়ে বলেন, ইতিহাসে শত শত নাক গলানোর উদাহারণ আছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাক গলাতে হয়। তাই এ খসড়া বাতিল করা উচিত। এই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একাত্তরে পাকিস্তানের গণহত্যা এবং রোহিঙ্গা ইস্যুটি বিশ্ব নেতাদের সামনে তুলে ধরা হয়। এ সময় যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে সতর্ক করার পরও বার বার পাকিস্তানের নাক গলানোর কঠোর সমালোচনা করে উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দেয় বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সুস্পষ্ট। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কোনো বিষয়ে নাক গলানোকে বাংলাদেশ সমর্থন করে না। বাংলাদেশের কূটনৈতিক পলিসিও সেটা সমর্থন করে না। তাই কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ বন্ধে আইপিইউর উদ্যোগে বাংলাদেশ সক্রিয় সমর্থন জানাবে।
এদিকে আইপিইউর খসড়া প্রস্তাব সমর্থন করে এ সংক্রান্ত বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ প্রতিনিধি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা, যার মাধ্যমে ৩০ লাখ মানুষ মারা গেছে এবং দুই লাখ নারীকে অসম্মান করা হয়েছে। সেই কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ এটিকে সমর্থন করে। বাংলাদেশ অন্য দেশের কোনো বিষয়ে নাক গলানোকে সমর্থন করে না। এক্ষেত্রে শুধু বিশেষ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের ম্যান্ডেট নিয়ে ইন্টারফেয়ার করা যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, অনেক দেশ এনজিওর মাধ্যমে নাক গলানোর চেষ্টা করে। এটি বন্ধ করতে হবে।
আইপিইউর খসড়া প্রস্তাবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো সরকারকে মিলিটারি বা অন্য যে কোনো শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উৎখাতের চেষ্টার চরম নিন্দা জানানো হয়। আর এক্ষেত্রে দেশের সুশীল সমাজ যাতে ভূমিকা না রাখে সে বিষয়ে সংসদকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়। এ খসড়া সমর্থন করে চীন জানিয়েছে, বিদেশি শক্তি এবং এর প্রভাব গ্রহণযোগ্য নয়। ২০০৩ সালে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অজুহাত দেখিয়ে একটি দেশ ইরাক আক্রমণ করেছিল; কিন্তু পরে দেখা গেছে সেখানে এ ধরনের কোনো অস্ত্র নেই। রাশিয়ান পার্লামেন্টের প্রতিনিধিরাও এই খসড়া প্রস্তাব সমর্থন করেন।
অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া জানান, বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়ে নেয়া খসড়া প্রস্তাবটি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গত কয়েক বছর ধরে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান ক্রমাগত নাক গলিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে এ বিষয়ে পাকিস্তানের সরকার ও তাদের জাতীয়-প্রাদেশিক সংসদগুলো বিভিন্ন ধরনের বিবৃতি দিয়েছে ও প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ তার চরম বিরোধিতা করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বড় সময় সামরিক শাসনের অধীনে কেটেছে। ১৯৭৫ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার মাধ্যমে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের সূচনা হয়। এরপর জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদ সামরিক শাসন জারি করেছেন। সর্বশেষ ২০০৭ সালে আবার সিভিলিয়ান সরকারের আড়ালে সামরিক সরকার দুই বছর বাংলাদেশ শাসন করেছে। আইপিইউ সম্মেলনেও বিষয়গুলো উত্থাপন করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
দিনব্যাপী আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ৪০টি দেশের মধ্যে ৩৫টিই বাংলাদেশের অবস্থানের পক্ষে ছিল বলে জানান বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য সাবেক মন্ত্রী ফারুক খান। তিনি বলেন, ওই প্রস্তাব ছাড়াও সেখানে আরো তিনটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে প্যালেস্টাইন, সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যাগুলো উঠে এসেছে। আজ সকালে আবারো এই আলোচনা শুরু হবে বলে তিনি জানান।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, গ্রুপ-১২প্লাস জোটের মোট ৪৭টি সদস্য দেশ এ খসড়ার চরম বিরোধিতা করছে। এ জোটের সদস্য জার্মানি জানিয়েছে, ইতিহাসে শত শত নাক গলানোর উদাহরণ আছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাক গলাতে হয়। তাই এ খসড়া বাতিল করা উচিত। একই সুরে কথা বলে ইউক্রেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড ও তুরস্ক। রাশিয়া ইউক্রেনের অংশ ক্রিমিয়া দখল করেছে। কিন্তু তারপরও অন্য দেশের নাক গলানো বন্ধের এ রেজ্যুলেশন বিরোধিতা করে ইউক্রেন জানিয়েছে, রাশিয়ার সংসদ ক্রিমিয়া দখলের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিল। তাই এ ধরনের খসড়ার কোনো গুরুত্ব নেই। বেলজিয়াম বিরোধিতা করে জানিয়েছে, এটি ভারসাম্যপূর্ণ খসড়া নয়। অন্যদিকে তুরস্ক আইপিইউ সম্মেলনে এ খসড়া নিয়ে আলোচনা না করার আহ্বান জানায়।
এ খসড়া প্রস্তাব সমর্থন করে চীন বলেছে, বিদেশি শক্তি এবং এর প্রভাব গ্রহণযোগ্য নয়। ২০০৩ সালে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অজুহাত দেখিয়ে একটি দেশ ইরাক আক্রমণ করেছিল; কিন্তু পরে দেখা গেছে সেখানে এ ধরনের কোনো অস্ত্র নেই। রাশিয়া এ খসড়া সমর্থন করে জানিয়েছে, এটি বাতিল করা হলে সারা বিশ্বে একটি ভুল বার্তা যাবে। ভারতও এ রেজ্যুলেশন সমর্থন করেছে বলে জানায় বৈঠক সংশ্লিষ্ট সূত্র।