মাশরাফি বাংলাদেশ ক্রিকেটের ধ্রুবতারা: আনন্দবাজার
আপডেট: ২০১৭-০৪-০৮ ১৩:২১:০৮
বাংলাদেশের ক্রিকেটের মহানায়কের বিদায়! মাশরাফিকে মহানায়কই বলতে হবে। কারণ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে তার অবদান ও ত্যাগ নিঃসন্দেহে বিরল। ইনজুরির সঙ্গে লড়াই করে বার বার ফিরে এসেছেন ক্রিকেটে। ক্রিকেট তার অস্থিমজ্জায় গাঁথা। ভক্তকূল মেনে না নিলেও বিদায় নিয়েছেন এ তারকা। বাংলাদেশের ধ্রুবতারা! হ্যাঁ ধ্রুবতারা, পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার তাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ধ্রুবতারা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
পুরো ক্রিকেট ক্যারিয়ারে মাশরাফির সাফল্য-দলের প্রতি তার ভালোবাসা ছাড়াও ব্যক্তি ম্যাশের গুণাগুণ তুলে ধরে একটি প্রশংসনীয় প্রতিবেদন ছাপিয়েছে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা। ‘বিদায় ক্যাপ্টেন’ নামে করা প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো।
‘দুই পায়ে মোট আটবার অস্ত্রোপচার। পা বাঁচাতে যখন মাশরাফিকে না খেলার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘পায়ে গুলি খেয়ে যদি মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করতে পারে, তাহলে আমি কেন সামান্য সার্জারি নিয়ে মাঠে খেলতে পারবো না?’
দৃঢ়চেতা মনোভাব, ব্যক্তিত্ব আর সহজাত ক্রিকেটীয় মেধার সঙ্গে দারুণ নেতৃত্বগুণ অন্য আরো ১০ জন ক্রিকেটার থেকে আলাদা করে চিনিয়েছে বাংলাদেশের ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিন মর্তুজাকে। তিনিই দেখিয়েছেন কেবল তীব্র ইচ্ছাশক্তি আর দেশের প্রতি প্রচুর ভালোবাসা থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব।
ম্যাচ জিতিয়ে গোটা দেশ যখন আনন্দে মাতে, মাশরাফি তখন হাঁটুর ব্যাথায় কাতরান ড্রেসিংরুমে। ক্রিকেটে তার মতো ইনজুরি জয় করা খেলোয়াড় আর একজন আছেন বলে ইতিহাস সাক্ষী দেয় না। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তিনি তাই ধ্রুবতারা!
প্রিয় ম্যাশ দেশের মানুষের হৃদয়ে কতটা জায়গা করে নিয়েছেন, তা বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা গণমাধ্যমে চোখ রাখলে সহজেই বোঝা যায়। বিদায়েও তাই খেলোয়াড় মাশরাফির বাইরে তাই মানুষ মাশরাফিকে নিয়েই জয়গান। টি-টোয়েন্টিতে অবসরের ঘোষণাতেই ব্যথিত বাংলার কোটি জনতা।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবার প্রিয় ম্যাশ বা পাগলার আবির্ভাব অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে প্রয়োজন ছিল একজন বোলারের, ঠিক সেই সময়ে প্রতিভা আর পরিশ্রমের মিশ্রণে একটু ভিন্ন ধাতুতে গড়া এই তরুণের খোঁজ পেল এ দেশের ক্রিকেট। আক্রমণাত্মক, গতিময় বোলিং দিয়ে প্রথমে নজর কেড়েছিলেন সবার। কালে পরিণত হয়ে তিনি এখন বাংলাদেশের সফলতম পেস বোলারদের একজন। সফলতম অধিনায়ক তো বটেই।
একটু একটু করে বেড়ে ওঠা আজকের মাশরাফির। ধারাবাহিকভাবে জয় করেছে হাজারও ক্রিকেটপ্রেমীর মন। শুধু খেলা দিয়ে নয়, বিনয় আর লড়াকু মনোভাবের সঙ্গে সহজাত নেতৃত্বের গুণ তাকে আর দশটা ক্রিকেটার থেকে আলাদা করে রেখেছে। ইনজুরিতে পড়ে পায়ে অপারেশনের এখন আর কোনো জায়গা বাকি নেই! তবুও তিনি বারবার মাঠে ফিরেছেন ক্রিকেটকে ভালোবেসে। জীবন বাজি রেখে, দেশকে ভালোবেসে খেলে গেছেন দেশের জন্য, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। ক্রিকেটে যতটা লড়াকু, ব্যক্তি হিসেবে ততটাই বিনয়ী মাশরাফি। আর এই বিনয়ে বশ বাংলার কোটি মানুষ। সহজাত বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা তো আছেই; সঙ্গে ভালোবাসা ও উদারতার এক উদাহরণও তিনি।
এই তো কিছুদিন আগে নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে মাঠে ঢুকে পড়া এক ভক্তকে যেভাবে বুকে টেনে নিলেন, তা হৃদয় ছুঁয়ে গেছে হাজারও ক্রিকেটপ্রেমীর। পরে তো আবার নিরাপত্তাকর্মীদের হাত থেকে তাকে রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন নিজেই। আবার বাংলার আবেগী ক্রিকেট দর্শক যখন ক্রিকেটারদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ উপাধি দিতে ফেসবুকে ইভেন্ট খোলেন তখন সেখানে গিয়েও প্রতিবাদ জানিয়ে মাশরাফি বলেন, ‘ক্রিকেটারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা টানলেই খুব খারাপ লাগে। আগেও অসংখ্যবার বলেছি, আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধ সব কিছুর আগে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্থান সব কিছুর ওপরে। সামান্য ক্রিকেট খেলা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়। ’
দলের কাছে কোনোদিন তিনি নামকাওয়াস্তে অধিনায়ক ছিলেন না। ছিলেন সবার প্রিয় ‘মাশরাফি ভাই’। দলটাকে সাজিয়ে রেখেছেন তিনি নিজের ঘরের মতো! নেই কোনো ভেদাভেদ, নেই কোনো কোন্দল। কারো বিয়ে, কিংবা কারো কোনো কাজে এগিয়ে যেতেন বড় ভাইয়ের মতোই।
এতো ইনজুরির ঝাপ্টা পেরিয়ে মাশরাফিকে তো যেতেই হতো একদিন। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এই বিদায় মানতে পারছেন না অনেক ক্রিকেট অনুরাগীই। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে ৬ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার দিনটা তাই কালো অক্ষরে লেখা থাকবে প্রিয় ক্যাপ্টেনের টি-টোয়েন্টি থেকে বিদায়ের দিন হিসেবেই। ’
বাংলাদেশের হয়ে ৫৪টি টি-২০ ম্যাচে ব্যাট হাতে ৩৭৭ রানের পাশাপাশি বল হাতে ৪২ উইকেটে শিকার করেছেন মাশরাফি। বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। তাই ম্যাশের হাত ধরেই সবচেয়ে বেশি জয়ের স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ। জাতীয় দলকে ২৮ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে ১০টি জয়ের স্বাদ দিয়েছেন মাশরাফি। এছাড়া ১৭টি হার ও ১টি পরিত্যক্ত ম্যাচও ছিলো ম্যাশের অধিনায়কত্বের পরিসংখ্যানে। সূত্র: আনন্দবাজার