তিস্তার বিকল্প হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাবে উভয় দেশের শীর্ষ পর্যায়ে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে। সরকারিভাবে কোনো দেশের কর্মকর্তারাই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তবে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় মমতা রাজনৈতিক কারণে তিস্তা ইস্যু থেকে দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা করছেন বলে তাঁরা মত দিয়েছেন। ওই প্রস্তাবকে তাঁদের অনেকে গুরুত্ব দিতে নারাজ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর শেষ হয়নি বলে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কেউই তাঁকে দেওয়া মমতার প্রস্তাব নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। একইভাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে কিছু বলতে চায়নি। দুই পক্ষই মনে করছে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যই নীতিগত অবস্থানের প্রতিফলন।
মমতার প্রস্তাবকে বাংলাদেশ গুরুত্ব দিতে নারাজ তিনটি কারণে। প্রথমত, এই প্রস্তাব ভারতের দিক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হয়নি বলে তা ব্যক্তিগত প্রস্তাব। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে আশ্বাস দিয়েছেন, তাতে তিস্তা চুক্তির আশু সমাধানের কথা বলা হয়েছে। তৃতীয়ত, দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতিতে তিস্তা ছাড়া আরও সাতটি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের আলোচনা দ্রুত শেষ করার কথা বলা হয়েছে।
তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বাস্তবতা হলো তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের চাওয়াটা আবারও ঝুলে গেল। গত শনিবার দুপুরে নরেন্দ্র মোদি জোর দিয়ে শেখ হাসিনাকে নিয়েই চুক্তিটি সই করার আশ্বাস দেন। তবে রাতে তিস্তার বদলে তোর্সা থেকে পানি নিতে শেখ হাসিনাকে বিকল্প প্রস্তাব দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর মাধ্যমে মমতা বুঝিয়ে দিলেন, তিস্তা নিয়ে আগের অবস্থান থেকে তিনি একচুলও সরেননি। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে একেবারে শেষ মুহূর্তে তাঁর বিরোধিতায় চুক্তিটি সই করতে পারেনি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন মনমোহন সিংয়ের ইউপিএ সরকার।
এবার চুক্তি সই না হলেও শেষ পর্যন্ত কবে তা হবে, এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট সময় চেয়েছিল বাংলাদেশ। মোদির আশ্বাসে আভাস আছে, সীমান্তের দুই পারে দুই সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তা হবে। এটা মেনে নিলে ২০১৮ সালে চুক্তিটি সই হওয়ার কথা। কিন্তু ২০১১ এবং এবারের পরিস্থিতির পর অভিন্ন নদীটির পানি পাওয়াটা শেষ পর্যন্ত অনিশ্চিতই থেকে গেল।
বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে শনি ও রোববার কথা বলে বোঝা গেছে, শুধু তিস্তা কেন, গঙ্গা ব্যারাজ ও অববাহিকা ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা নিয়েও হতাশা আছে। প্রায় ছয় বছর আগে তিস্তা নিয়ে দুই দেশ যেখানটায় রাজি ছিল, সেই অবস্থায় থেকে চুক্তিটি সইয়ের জন্য ভারতের কাছে একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা চেয়েছিল বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে শীর্ষ বৈঠক এবং এর আগের অনানুষ্ঠানিক কয়েকটি বৈঠকেও সেই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লিতে পৌঁছানোর কয়েক ঘণ্টা আগেও পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জয়শঙ্করের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেন।
জানা গেছে, তিস্তার মতো গঙ্গা ব্যারাজের ব্যাপারেও সময়সীমা ধরে কাজ করতে চেয়েছিল বাংলাদেশ। যেহেতু ভারত যৌথ সমীক্ষায় রাজি হয়েছে, তাই ডিসেম্বরে গঠিত কারিগরি কমিটির বৈঠকটি মে মাসের মধ্যে করতে চেয়েছিল বাংলাদেশ। যৌথ ঘোষণায় এ নিয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবটি অবশ্য টেকেনি।
সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার দুপুরে তিস্তা নিয়ে মোদি যেভাবে দুই সরকার চুক্তি সই করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন, সেভাবেই বক্তব্যটা যৌথ ঘোষণায় রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ। ভারত প্রস্তাবটি রাখতে রাজি হয়নি।
শনিবার সন্ধ্যায় দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকের যৌথ ঘোষণা প্রচারের আগে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর তিস্তা নিয়ে রাখা বক্তব্যের মূল কথাটা যৌথ ঘোষণায় থাকছে কি না। শহীদুল হক বলেন, কোনো প্রধানমন্ত্রী যখন কোনো অঙ্গীকার করেন, সেটিকে নীতিগত বিবৃতি হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়। কাজেই এটা কোনো দলিলে যুক্ত করা প্রয়োজন হয় না।