চোরাচালানের সোনা দিয়েই চলে জুয়েলারি ব্যবসা

প্রকাশ: ২০১৭-০৫-১৭ ১২:০৮:২৭


Goldদেশে সোনার খনি নেই, আবার আমদানি করার অনুমতিও নেই। অথচ দেশজুড়ে দিব্যি গড়ে উঠেছে ২০ হাজারেরও বেশি সোনার দোকান। এসব দোকানে নিয়মিতভাবে গয়না তৈরি হচ্ছে, ভাঙাও হচ্ছে; কাজ করে যাচ্ছেন কারিগরসহ দেড় লাখেরও বেশি শ্রমিক। রাজধানী থেকে মফস্বল শহর সবখানে জুয়েলারি দোকানের ভীষণ কদর। কিন্তু, এসব দোকানে যে সোনা ব্যবহার হয়, প্রশ্ন ওঠে তার উৎস কি?

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির তথ্য মতে, পুরনো সোনা ‘রিফাইন’ বা পরিশোধন করে দেশে গয়না তৈরি হয়। কিন্তু, বাস্তবতা বলে, মূলত চোরাচালানের সোনা দিয়েই চলছে দেশের জুয়েলারি ব্যবসা।দেশে সোনা আমদানির বৈধতা না থাকায় বাধ্য হয়েই চোরাচালানকে আঁকড়ে ধরে আছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।

সম্প্রতি, বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাক-বাজেট আলোচনায় সংগঠনটির সহ-সভাপতি এনামুল হক শামীম বিষয়টি স্বীকার করে জানান, ‘বর্তমান বাজারে সোনার বড় অংশের জোগান আসে কালোবাজারের মাধ্যমে।এছাড়াও সামান্য অংশ আসে বিদেশ থেকে ব্যক্তিগতভাবে আনার বৈধ অনুমতিপত্রের মাধ্যমে। মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যবসায়ী দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সোনা কিনে থাকেন। বাকিরা কালোবাজার ও ভারত থেকে সোনা সংগ্রহ করে।’

উচ্চ শুল্ক আরোপের কারণে দেশে সোনার চোরাচালান বেড়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

এ দিকে প্রতিদিনই দেশের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর কিংবা বিভিন্ন চোরাই পথে আসা সোনা আটক হচ্ছে। শুল্ক ও গোয়েন্দাদের হাতে কখনও কখনও কেজির হিসাবকে ছাড়িয়ে মণকে মণ সোনা ধরা পড়ছে। চোরাই পথে আসা সোনার একটা অংশ চলে যাচ্ছে জুয়েলারি দোকানগুলোতে।

এ প্রসঙ্গে এনামুল হক শামীম বলেন, সোনা চোরাচালানের সঙ্গে দেশের প্রায় ৫০ হাজার লোক জড়িত।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চোরাচালান থেকেও ব্যবসায়ীরা কালেকশন (সংগ্রহ) করে, আবার ১০০ গ্রাম করে স্বর্ণ আনার যে সুযোগ আছে, সেখান থেকেও কালেকশন (সংগ্রহ) করে। সোনার বাজারটা মূলত অস্বচ্ছ। এটাকে স্বচ্ছ করতে হলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।’

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিপুল পরিমাণ সোনা চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসলেও এর একটা বড় অংশ চলে যায় পাশের দেশ ভারতে। এ ছাড়া ব্যাগেজ রুলের আওতায় সীমিত আকারে আমদানির সুযোগও আছে। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে চোরাচালানের সোনাও দোকানে আসতে পারে। এক্ষেত্রে  জুয়েলার্স ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী, সোনা আমদানির বিষয়টি সহজ করা যেতে পারে।

এদিকে সোমবার রাতে আপন জুয়েলার্সের দোকান থেকে ২১১ কেজি সোনা আর ৩৬৮ গ্রাম হীরা আটক করে শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদফতর। এই বিপুল পরিমাণ সোনা ও হীরার বৈধ সরবরাহের কোনও কাগজ দেখাতে পারেননি আপন জুয়েলার্স কর্তৃপক্ষ। আটককৃত সোনা ও হীরার মূল্য ৯৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

প্রসঙ্গত, বনানীতে দু’জন তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলায় প্রধান অভিযুক্ত সাফাত আহমেদের বাবা দিলদার আহমেদ আপন জুয়েলার্সের মালিক।

এ প্রসঙ্গে জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি গঙ্গা চরণ মালাকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এতদিন সোনার উৎস সম্পর্কে আমাদের কোনও প্রশ্ন করা হয়নি। এর ফলে অনেকেই কমবেশি সুবিধা নিয়েছেন। তাহলে সোনার উৎস না জেনে এতদিন আমাদের কাছ থেকে যে ভ্যাট নেওয়া হয়েছে, যে আয়কর নেওয়া হয়েছে তাও কি অবৈধ হবে?’

তিনি আরও বলেন,‘‘সোনা আমদানির সুযোগ চেয়ে আমরা সরকারের কাছে বার বার গিয়েছি। ২০ বছর ধরে আমরা ‘স্বর্ণ নীতিমালা’ চাচ্ছি।  অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আমরা এ নিয়ে কতবার গিয়েছি,  কিন্তু কোনও কিছুই হয়নি।’’

অবশ্য জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলিপ কুমার আগারওয়ালা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুরনো সোনা রিফাইন (পরিশোধন) করে এবং বিদেশ থেকে ১০০ গ্রাম করে সোনা এনে অনেকে দোকানে বিক্রি করেন। সেই সোনা দিয়েও বিভিন্ন ধরনের গহনা তৈরি করা হয়।’

তিনি জানান, ঢাকায় জুয়েলার্স সমিতির ৬শ’ সদস্য ছাড়াও আরও ১০ হাজার সোনার দোকান রয়েছে। আর সারাদেশে প্রায় ২০ হাজার জুয়েলারি দোকান ব্যবসা করছে।

বাংলাদেশের ভেতরে প্রতিবছর সোনার চাহিদা এবং জোগান কত সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও পরিসংখ্যান নেই। তবে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২৫ লাখ ভরি সোনার চাহিদা রয়েছে।