সংসদে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি

প্রকাশ: ২০১৭-০৯-১৩ ২৩:২০:৫৫


parlamentসংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ও আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণের কিছু বিষয়ে ‘আইনি পদক্ষেপ’ নেয়ার একটি প্রস্তাব জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে।

বুধবার প্রস্তাবটির ওপর দীর্ঘক্ষণ আলোচনায় জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্যরা এ ব্যাপারে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নিতে আইনমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।

এ সময় তারা সংসদ, বিচারবিভাগ ও স্বাধীনতাযুদ্ধে একক নেতৃত্বসহ কিছু বিষয়ে পর্যবেক্ষণে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করায় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার কড়া সমালোচনা করেন।

রায় ও পর্যবেক্ষণের সমালোচনা করে তারা বলেন, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর পাঁয়তারা চলছে। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে তারা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রিটে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারীদেরও (একজন ছাড়া) তীব্র সমালোচনা করেন।

এই রায় ও পর্যবেক্ষণকে অশুভ শক্তিকে ক্ষমতায় আনার পাঁয়তারা বলেও অভিযোগ তোলেন আলোচক সংসদ সদস্যরা।

তারা এসকে সিনহার বিরুদ্ধে অসাদাচরণের অভিযোগ উত্থাপন করে বলেন, তার বিরুদ্ধে (এসকে সিনহা) অনিয়ম, দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সঙ্গে সখ্যতার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখে এসকে সিনহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও দাবি জানান তারা।

সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭ ধারায় এ বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব উত্থাপন করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) একাংশের কার্যকরী সভাপতি মইন উদ্দীন খান বাদল। প্রস্তাবটির ওপর সরকারি, বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সদস্যদের অনেকে আলোচনায় অংশ নেন। পরে এটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনে এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন।

মইন উদ্দীন খান বাদল তার প্রস্তাবে বলেন, সংসদের অভিমত এই যে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেয়া রায় বাতিল এবং রায়ে জাতীয় সংসদ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির দেয়া অসাংবিধানিক, আপত্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ বাতিল করার জন্য যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।

প্রস্তাবটির ওপর আলোচনায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আমাদের কিংবা এই সংসদকে কেউ ছোট করে কথা বললে সমগ্র জাতিকেই ছোট করা হয়।

তিনি বলেন, সংসদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে স্বাভাবিকভাবেই আমরা দুঃখিত হই। এই সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে যত্নসহকারে আমরা এই সংশোধনী এনেছিলাম, ’৭২-এর মূল সংবিধানে ফিরিয়ে নিয়েছিলাম।

প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, এই রায়ের পর বিএনপি খুশি হয়েছে। সরকারকে অনুরোধ করব, ২০১২ সালের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কোনো অস্বিত্ব নেই তা তুলে ধরেন। তাছাড়া ষোড়শ সংশোধনীতে ইম্পিচমেন্ট বলতে কিছু নেই, রিমুভের কথা আছে। এই ধরনের রায় দেয়ার ক্ষমতা আপিল বিভাগের নেই।

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, বিচারবিভাগের স্বাধীনতার নামে স্বাধীনতা বা সার্বভৌমত্ব কি আমরা অস্বীকার করতে পারি? এই রায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রের অন্য দুটি অঙ্গকে অস্বীকার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, এই রায় দেয়ার কোনো এখতিয়ার আপিল বিভাগের নেই। কাজেই এই রায় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আইনমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো এই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন।

আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি বলেন, কাদের পারপাস সার্ভ করতে এই অশুভ পাঁয়তারা? পাকিস্তানের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কেন তাদের এত পছন্দ? সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অনুসরণ করে পাকিস্তানসহ কয়েকটি ব্যর্থ রাষ্ট্র।

তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি যেসব কাজকর্ম করছেন, তিনি বিচারবিভাগকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছেন। প্রধান বিচারপতিকে বলতে চাই, আপনি বলেছেন বিচারবিভাগ ডুবতে ডুবতে নাক উঁচু করে কোনোভাবে টিকে আছে, এই ধরনের অসত্য বক্তব্য দেবেন না।

আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্য বলেন, আইনমন্ত্রীকে বলবো এই রায়, পর্যবেক্ষণ ও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, আমরা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। আর রক্তের চাদরেই এই সংবিধান। আইন পরিষদের কাজ আইন প্রণয়ন করা, আর বিচারপতিরা আইনের ব্যাখ্যা দেবেন। সংসদ সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাই। অনেক সংসদ সদস্যের ত্যাগ, অবদান, সততা ও জ্ঞানকে অস্বীকার করা সমীচীন হয়নি।

প্রসঙ্গত, গত ১ আগস্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়, যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা চলে। রায়ে ষোড়শ সংশোধনীকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হয় এবং সামরিক শাসনামলে চালু করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যবস্থা পুনঃস্থাপিত করার কথা বলা হয়।

সাত বিচারপতির ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার এই রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন।