‘স্ত্রী-ছেলে হত্যার নেপথ্যে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে’
প্রকাশ: ২০১৭-১১-০২ ১৭:০৭:৩৫
রাজধানীর কাকরাইলে মা ও ছেলে হত্যাকাণ্ডের পেছনে পারিবারিক কলহ বা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব কারণ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এ দুটি বিষয়কে সামনে রেখে এগুচ্ছেন তদন্তের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টরা। তবে তদন্তে বারবার সামনে আসছে পারিবারিক কলহের বিষয়টি। নিহত শামসুন্নাহারের (৪৫) স্বামী আবদুল করিমের দ্বিতীয় স্ত্রী রয়েছে। এ নিয়ে পারিবারিক কলহ ছিল। এর জের ধরেই শামসুন্নাহার ও তার ছেলে শাওন খুন হতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।
জানা গেছে, দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে গত কয়েকবছর ধরে আবদুল করিমের সঙ্গে প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহারের নিয়মিতই ঝগড়া-ঝাটি ও হাতাহাতির ঘটনাও ঘটতো। বিভিন্ন সময়ে এগুলো মিটমাট করতেন আশপাশের ভাড়াটিয়ারা। এ কলহ নিয়ে বিভিন্ন সময় শামসুন্নাহারকে গলা কেটে হত্যার হুমকি দিতেন আবদুল করিম।
১ নভেম্বর বুধবার সন্ধ্যায় কাকরাইলের ৭৯/এ নম্বর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম রোডের নিজ বাড়িতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হন শামসুন্নাহার ও তার ছেলে শাওন। শাওন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল ও কলেজের ‘ও লেভেল’ শিক্ষার্থী ছিলেন। শামসুন্নাহারের স্বামী আবদুল করিম পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী ও চলচ্চিত্র প্রযোজক।
আবদুল করিমের ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া জাকির বলেন, ‘আমি গত ছয় বছর থেকে এই বাড়ির ছয়তলায় ভাড়া থাকি। এই পরিবারটির সঙ্গে আমরা কানেকটেড। করিম সাহেবের প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহার গত বছরের শেষের দিকে তার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি জানেন এবং আমাদের জানান। আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ আর করিম সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়িও একই জেলায়। তাই টাকা-পয়সা দিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রীকে করিমের জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলাম আমরা। তবে আট মাস আগে দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে করিমের দ্বন্দ্ব হয়। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে স্ত্রী করিমের শার্ট ছিঁড়ে ফেলেন। পরে করিম বাড়ি থেকে বের হয়ে যান, দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে পল্টনের একটি ফ্ল্যাটে ওঠেন।’
বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটিয়ারা জানান, বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর বেশ কয়েকবার কাকরাইলের এই বাড়িতে এসে প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহারকে ‘গলা কেটে হত্যার’ হুমকি দিয়েছেন আবদুল করিম।
এদিকে, তদন্তের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ঘটনার পরপরই স্বামী আবদুল করিম, নিহত মা-ছেলেসহ তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মোবাইল ফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর) নিয়ে তদন্তকাজ শুরু করেছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটির ছায়া তদন্ত করছে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) ও র্যাব। এই দুই বাহিনীর ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে। এখন চলছে আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
এরআগে বুধবার রাতেই ওই বাড়িতে প্রবেশের গলির সামনে স্থাপিত একটি এবং কাকরাইল ও এর আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে আসামি শনাক্তের চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।
রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মাঈনুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ ঘটনায় হত্যা মামলা প্রক্রিয়াধীন। তদন্ত অব্যাহত আছে, আবদুল করিমকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।’
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, ওই বাড়ির পাশেই প্রাচীর ঘেরা একটি খালি প্লট রয়েছে। ইটের প্রাচীরটি প্রায় তিন ফুটের মতো উঁচু। ফলে ওই প্লটের সীমানাপ্রাচীরের ওপর দিয়ে আবদুল করিমের বাড়িতে প্রবেশ ও বাড়ি থেকে কাকরাইল মোড়ের মূল সড়কে যাওয়ার রাস্তা রয়েছে। আসামিরা সেদিক দিয়ে এসে একইভাবে পালিয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
এই হত্যাকাণ্ডে ঠিক কতজন অংশ নিয়েছে- তা জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের ধারণা দুর্বৃত্তের সংখ্যা ৬-৭ জনের কম নয়। কারণ ধারালো অস্ত্রের আঘাতের পর যে কেউ শরীরের সর্বশক্তি নিয়োগ করে বাঁচার চেষ্টা করেন। তাই তাদের সামলাতে কমপক্ষে ৫-৬ জন এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, আসামিদের ধরতে বুধবার সন্ধ্যা ৭টার পর থেকেই কাকরাইলের আশপাশের এলাকা এবং ঢাকার প্রবেশ ও প্রস্থানপথে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সন্দেহভাজনদের তল্লাশি করা হচ্ছে। তবে শাওনের মরদেহের পাশ থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রটি আদৌ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছে কিনা তা জানতে অস্ত্রটি পরীক্ষার জন্য ল্যাবে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সন্দেহভাজন হিসেবে আবদুল করিমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনা হয়েছে। এছাড়া প্রহরা সত্ত্বেও হত্যাকারীদের বাড়িতে প্রবেশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সন্দেহভাজন হিসেবে থানায় আনা হয়েছে বাড়ির প্রহরী আবদুল নোমান। এছাড়া বাড়ির গৃহকর্মী রাশেদা বেগমকে থানায় আনা হয়। ঘটনা সম্পর্কে গৃহকর্মী রাশেদা বেগম জানান, তিনি সন্ধ্যায় ওই বাসায় কাজ করতে যান। শামসুন্নাহার নিজেই তাকে গেট খুলে দেন। এরপর তিনি রান্নাঘরে থালা-বাসন মাজতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর কে বা কারা তার রান্নাঘরের দরজা আটকে দেয়। এরপরই শামসুন্নাহারের ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকারের শব্দ শুনতে পান তিনি। পরে দারোয়ান এসে রান্নাঘরের দরজা খুলে দিলে রক্তাক্ত অবস্থায় শামসুন্নাহারকে পড়ে থাকতে দেখেন তিনি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, নিহতের প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ড নিয়ে সম্ভাব্য কয়েকটি কারণ সামনে রেখে তদন্তকাজ চলছে। এগুলোর মধ্যে আবদুল করিমের পারিবারিক কলহ অন্যতম। এছাড়া তদন্তে পরিবারটির ধর্মীয় মতাদর্শের বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
সূত্র জানায়, পেশায় আবদুল করিম আদা-রসুন-পেঁয়াজ আমদানিকারক। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা এবং নিজেও অভিনয় করেছেন। পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর কারণ নিজের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বও হতে পারে বলে মনে করছে পুলিশ। হয়তো আবদুল করিমকে হত্যার জন্য বাড়িতে এসে, তাকে না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে দুর্র্বত্তরা- এমন ধারণা নিয়েও কাজ করছে পুলিশ।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘এ ঘটনায় কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এই বাড়ি ছাড়াও কাকরাইল এলাকায় আবদুল করিমের আরও দুটি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। সব কিছু মাথায় রেখে তদন্ত চলছে।’ নিহত মা ও ছেলের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।