বাংলার রসগোল্লার অকথিত ‘নারী বিপ্লবী’ ক্ষীরোদমণি
প্রকাশ: ২০১৭-১১-১৭ ২২:২০:৪২
দেবযানী সরকার: অনেকেই বলেন, সব পুরুষদের সাফল্যের পিছনেই নাকি কোনও না কোনও নারীর হাত থাকে৷ রসগোল্লার আবিষ্কর্তা হিসেবে গোটা বিশ্ব যাঁকে চেনে সেই নবীন চন্দ্র দাসের সাফল্যের পিছনেও আছেন এক নারী৷ তিনি নবীনচন্দ্র দাসের স্ত্রী ক্ষীরোদমণি দেবী৷ জানা যায়, নবীন চন্দ্র দাসের গোটা ব্যবসার রাশ ছিল তাঁর হাতেই৷
খ্যাতির আড়ালে থেকে গিয়েছেন ক্ষীরোদমণি দেবী৷ রসগোল্লার কারিগর নবীন চন্দ্র দাসের স্ত্রী ছিলেন তিনি৷ প্রখ্যাত মিষ্টান্ন কারিগর ভোলা ময়রার মেয়ে৷ চোদ্দ বছর বয়সে নবীন ময়রার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়৷ রাশভারী মহিলা ছিলেন৷ স্বামীর উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকলেও যেহেতু ব্যবসায়িক দক্ষতা ছিল না তাই ক্ষীরোদমণি দেবীই ব্যবসার রাশ নিজের হাতে নেন৷ এমনকি ছেলে কে.সি দাস আলাদা দোকান করলেও আমৃত্যু পর্যন্ত নবীন চন্দ্র দাসের দোকান একাই চালিয়েছেন তিনি৷
উনিশ শতকের ভারতে এও এক নারী বিপ্লব৷ গৃহলক্ষ্মীর হাতে ব্যবসায়ী মহিলার লক্ষ্মীলাভ৷ কেমন ছিল সেই সময়? নবীনবাবুর পরিবার সূত্রে জানা যায় যে তাঁর উত্থানের পথ কতটা অমসৃণ, অনুর্বর ছিল৷
সদ্য বাংলার রসগোল্লা আন্তজার্তিক স্বীকৃতি পেয়েছে৷ রসগোল্লার জি আই রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার পরই বাঙালির মুখে ঘুরে ফিরেই নবীন চন্দ্র দাসের নাম৷ রসগোল্লার কারণে গোটা বিশ্ব এখন যাঁকে এক নামে চেনে৷ তাঁর পঞ্চম প্রজন্ম ধীমান দাস জানিয়েছেন, পূর্বপুরুষদের কথা৷
প্রথমদিকে নবীনবাবুদের ক্রিস্টাল সুগার রিফাইনের ব্যবসা ছিল৷ তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁকে পারিবারিক ব্যবসা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়৷ জমানো টাকা দিয়ে খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করেন তিনি৷ তাই বেশি দূর পড়াশোনা হয়নি৷ মা-ছেলে দুজনের সংসার সামলাতে ১৬-১৭ বছর বয়সে কালীদাস ইন্দ্র নামে এক মিষ্টি বিক্রেতার কাছে কারিগরের কাজ নেন৷ কিন্তু সেখান থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি৷
এরপর মায়ের জমানো টাকায় ১৮৬৪ সালে জোড়াসাঁকোতে একটি দোকান করেছিলেন নবীনবাবু৷ কিন্তু সেটা চলেনি৷ তারপর ফের মায়ের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ওই কালীদাস ইন্দ্রের দোকানের উল্টোদিকে আবারও একটি মিষ্টির দোকান করেছিলেন তিনি৷ কিন্তু সেই ব্যবসাও ভালমতো চলত না৷ সেইসময় কিছু লোকজন তাঁকে বলতেন এমন মিষ্টি তৈরি করতে যাতে খিদের সঙ্গে তেষ্টাও মেটে৷
এরপরই তিনি ছানার বল করে রসে দিলেন৷ কিন্তু প্রথম প্রথম তা ছেড়ে যেত৷ তারপর বেশ কিছুদিন এরকম হওয়ার পর শেষপর্যন্ত ঠিক হয়৷ সেই খুশিতে এবং নিজের মিষ্টির প্রচারের জন্য তিনি প্রায় সকলকে বিনা পয়সায় মিষ্টি বিলোতে থাকেন৷ সেই সময় তাঁর বয়স ২৩ বছর৷
একদিন তাঁদের বাগবাজারের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় একটি ঘোড়া টানা গাড়ি। গাড়িতে ছিল কলকাতার ধনাঢ্য ব্যক্তি, ভগবান দাস বাগলার পরিবার। ভগবান দাসের এক ছেলের পিপাসা পেলে সে গাড়ি থেকে নেমে ওই মিষ্টির দোকানের সামনে আসে। ভগবান দাস ওই ছেলেটিকে এক গ্লাস জল ও একটি রসগোল্লা দেন। রসগোল্লা খেয়ে ওই ছেলে বেজায় খুশি হয়ে বাবাকে বলেন তোমারও খেতে হবে এই মিষ্টি। ভগবান দাস এরপর এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতার ছড়িয়ে পড়ে রসগোল্লার সুখ্যাতি।
সুখ্যাতি তো ছড়াল৷ কিন্তু ব্যবসার হাল ধরবে কে? রসগোল্লার কারিগর তখন মিষ্টি শুভেচ্ছায় মোহিত৷ তাতেই লাটে উঠতে পারে ব্যবসা৷ অগত্যা হাল ধরলেন স্ত্রী ক্ষীরোদমণি৷ বাংলার মিষ্টান্ন শিল্পে জড়িয়ে গেল এই গৃহবধূর নাম৷ তিনি না থাকলে হয়তো রসগোল্লা হারিয়েই যেত৷
কলকাতার ভিড়ে জমে আছে সেই কথা৷ এক আটপৌরে গৃহবধূর ব্যবসায়িক সফল হওয়ার কাহিনী৷ বিপ্লব কি নিঃশব্দে হয় ?