পিলখানা হত্যা মামলার আপিলের রায় পড়ছে হাই কোর্ট

প্রকাশ: ২০১৭-১১-২৬ ১৩:১৯:৪৮


পিলখানা-হত্যাবাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তরে আট বছর আগে বিদ্রোহের ঘটনায় অর্ধশতাধিক সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করছে হাই কোর্ট।
বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের হাই কোর্ট বেঞ্চ রোববার সকাল ১০টা ৫৪ মিনিটে আলোচিত এ মামলার রায় পড়া শুরু করে।

হাই কোর্টের বিশেষ এই বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার। আসামির সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য ২০১৫ সালে এই বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করা হয়।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে নাম বিজিবি) সদরদপ্তরে রক্তাক্ত বিদ্রোহের এই ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান।

বিডিআর জওয়ানদের ওই রক্তাক্ত বিদ্রোহের পর ৫৭টি বিদ্রোহের মামলার বিচার হয় বাহিনীর নিজস্ব আদালতে। আর হত্যাকাণ্ডের বিচার চলে বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত মহানগর দায়রা জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে।

ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এই হত্যা মামলায় যে রায় ঘোষণা করেন, তাতে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়া বিডিআরের উপ সহকারী পরিচালক তৌহিদুল আলমসহ বাহিনীর ১৫২ জওয়ান ও নন কমিশন্ড কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ আসে। পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।

এ মামলার সাড়ে ৮০০ আসামির মধ্যে ওই রায়ের দিন পর্যন্ত জীবিত ছিলেন ৮৪৬ জন। তাদের মধ্যে ১৬১ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

পাশাপাশি অস্ত্র লুটের দায়ে তাদের আরও ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা জারিমানা, অনাদায়ে আরও দুই বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারক। এছাড়া ২৫৬ আসামিকে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। কারও কারও সাজার আদেশ হয় একাধিক ধারায়।

অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় রায়ে ২৭৭ জনকে বেকসুর খালাস দেয় বিচারিক আদালত।

পরে রায়ের বিরুদ্ধে খালাসপ্রাপ্ত ২৭৭ জনের মধ্যে ৬৯ জন আসামির সর্বোচ্চ সাজা চেয়ে হাই কোর্টে ফৌজদারি আপিল ও ডেথ রেফারেন্স দায়ের করে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত ৪১০ জন আসামির সাজা বাতিল চেয়ে আপিল করেন তাদের আইনজীবীরা।
এর মধ্যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েক আসামির মৃত্যুদণ্ড ও কয়েকজনের সাজা বাড়াতে আরও দুটি আবেদন করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু দেরিতে আবেদন করায় গত ১৩ এপ্রিল আবেদন দুটিও বাতিল করে দেয় হাই কোর্ট। পরে এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাই কোর্টের আদেশই বহাল রাখে।

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর গত ১৩ এপ্রিল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখে আদালত। তার সাত মাস ১২ দিন হাই কোর্ট রায় ঘোষণা করছে।

এ মামলার হাই কোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, মোমতাজ উদ্দিন ফকির, মোশাররফ হোসেন কাজল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোশাররফ হোসেন সরদার, শেখ বাহারুল ইসলাম ও জাহিদ সরওয়ার কাজল।

আসামিপক্ষে আইনজীবী ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুল বাসেত মজুমদার, মহসীন রশীদ, এস এম শাহজাহান, এ এস এম আবদুল মুবিন, মো. আমিনুল ইসলাম, দাউদুর রহমান মিনা ও শামীম সরদারসহ আরও অনেকে। আসামিপক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী ছিলেন হাসনা বেগম।

রায় অপেক্ষমাণ রাখার দিন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “এই মামলায় কিছু আসামি আছে যাদের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিৎ ছিল, কিন্তু হয়নি। কিছু আসামি আছে, যারা খালাস পেয়েছেন তাদের সাজা বৃদ্ধি চেয়ে এবং খালাসের বিরুদ্ধে তিনটি আপিল করেছিলাম। কিন্তু দেরিতে আবেদন করায় দুটি আবেদন নাকচ করে দিয়েছে আদালত।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সেদিন বলেন, “এই মামলায় এত লোককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, তাদের সবার ফাঁসি বহাল থাকে কি না বলা যাচ্ছে না। আবার যাদের সাজা হয়েছে তাদের সবাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কি না সেটি আদালত বিবেচনায় নেবেন।”

এই হত্যাকাণ্ডকে খুবই নৃশংস উল্লেখ করে মাহবুবে আলম বলেন, “যে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছে, তাদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই।”

আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী আমিনুল সেদিন সাংবাদিকদের বলেন, “আসামিদের অপরাধ প্রমাণের জন্য যে ধরনের সাক্ষ্য-প্রমাণ দরকার হয়, রাষ্ট্রপক্ষ তা উপস্থাপন করতে পারেনি। ফলে আশা করছি, অধিকাংশ আসামিই খালাস পাবেন।”

নিম্ন আদালতে এ মামলায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীকেও যাবজ্জীন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে পিন্টু ২০১৫ সালের ৩ মে রাজশাহী কারাগারে থাকা অবস্থায় হৃদরোগে মারা যান।

সেদিন যা ঘটেছিল

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার পরপরই পিলখানা বিডিআর সদরদপ্তরে গুলির শব্দ পাওয়া যেতে থাকে। বিডিআর সপ্তাহ চলার কারণে প্রথমে অনেকেই ভাবছিলেন, কোনো কর্মসূচি চলছে। কিন্তু কিছু সময় পর জানা যায়- বিদ্রোহ হয়েছে; পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জওয়ানরা।

বিদ্রোহের পর সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এরই মধ্যে পিলখানার চারদিকে সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়।

এদিকে পিলখানার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় বিডিআর দপ্তরে বিদ্রোহের খবর আসতে থাকে।

এক পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে শুরু হয় আলোচনা। তৎকালীন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, হুইপ মীর্জা আজম ও সাংসদ ফজলে নূর তাপস এ আলোচনার নেতৃত্ব দেন।
বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও বিদ্রোহীদের আলোচনা হয়। পরে পিলখানার প্রধান ফটকের পাশের একটি রেস্তোরাঁয় আলোচনায় অংশ নেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন।

গভীর রাতে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পিলখানায় গেলে বিদ্রোহীরা তার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেরিয়ে আসার সময় বিদ্রোহীদের হাতে জিম্মি কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। তারা মুক্ত হন।

কিন্তু এরপরও পিলখানা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল থেকে পিলখানা শূন্য হয়ে পড়লে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবসান ঘটে প্রায় ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের।

এদিকে বিদ্রোহের প্রথম দিন দুপুরে কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধের কাছে ম্যানহোলের মুখে দুই বিডিআর কর্মকর্তার লাশ পাওয়া গেলে হৈ চৈ পড়ে যায়। বোঝা যায়, ভেতরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

বিদ্রোহ অবসানের পরদিন পিলখানায় পাওয়া যায় একাধিক গণকবর। সেখানে পাওয়া যায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের লাশ।

রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পুনর্গঠন করা হয়। নাম বদলের পর এ বাহিনী এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) হিসেবে পরিচিত।

‘উদ্দেশ্য ছিল সামরিক নিরাপত্তা ধ্বংস’
জজ আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির ‘অপারেশন ডালভাত’ কর্মসূচিতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরকে জড়ানো ঠিক হয়নি। এটা বাহিনীর ‘ঐতিহ্য’ নষ্ট করেছে।

রায়ে বলা হয়, ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনার পেছনে অর্থনৈতিক ‘মোটিভ’ ছিল। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ‘মোটিভও’ থাকতে পারে।

এই বিদ্রোহের তথ্য আগে জানতে না পারার ঘটনায় ‘গোয়েন্দা দুর্বলতা’ ছিল বলেও মনে করেছে আদালত।

সেই রায়ে বিচারক বলেন, “সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধ্বংস করার মোটিভ নিয়ে এই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। বহির্বিশ্বের কাছে আমাদের দেশকে ছোট করা, বিদেশি বিনিয়োগ না আসার জন্য কলকাঠি নাড়া হয়েছে।”

আদালত মনে করে, দেশের ‘অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড’ দুর্বল করার জন্য ওই বিদ্রোহ ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। আর সশস্ত্র বাহিনীকে নিরুত্সাহিত করাও এর একটি কারণ হতে পারে।

এই বাহিনীর সদস্যদের আবারও জাতিসংঘ শান্তি মিশনে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া এবং পিলখানার ভেতরে স্কুলে সাধারণ বিডিআর সদস্যদের সন্তানদের ভর্তির ব্যাপারে আরও ছাড় দেয়ার পরামর্শ দেন বিচারক।

“সেনাসদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে বিডিআর সদস্যরা দেশের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত আছেন। এ জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতো ২০ শতাংশ ভাতা তাদের পাওয়া উচিত। তাদের ঝুঁকিভাতা দেয়া যায় কি না, তাও দেখা উচিত,” পর্যবেক্ষণে বলেন তিনি।