রুশ বিপ্লব, ‘নয়া কাশ্মীর’ এবং একজন ফ্রেডা বেদি
প্রকাশ: ২০১৭-১২-১৩ ১২:২১:৪৮
২০১৭ প্রায় শেষ। রুশিদের অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ উপলক্ষে এ বছর সারা বিশ্বে বেশ আলোচনা, পর্যালোচনা এবং উৎসব হলো। বাংলাদেশেও লেফটরা অনেক সভা-সমাবেশে করেছেন। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রুশ বিপ্লব কী কীভাবে প্রভাব রেখেছিল এবং তার ফল কী হয়েছে, সে বিষয়ে অনুসন্ধানী গবেষণা এখনো এ অঞ্চলে কম। যদিও স্তুতির চেয়ে বাস্তব প্রভাব সম্পর্কে পুনঃপুন পর্যালোচনা এবং তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরাই ঐতিহাসিক কোনো উপলক্ষকে স্মরণ করার সবচেয়ে ভালো পথ।
রুশদের বিপ্লব দক্ষিণ এশিয়ায় কীভাবে পরিবর্তনের রেখাচিত্র তৈরি করেছিল, তার একটি ভালো উদাহরণ হলো কাশ্মীর। কাশ্মীরের ইতিহাসের ঐতিহাসিক এক মুহূর্তে রুশ বিপ্লবের প্রবল ছাপ পড়েছিল এবং তারই ফল ছিল কাশ্মীরের ভূমি ও কৃষি সংস্কার। আমরা অনেকেই জানি না যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম কাশ্মীরেই কৃষি ও ভূমি সংস্কারের কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয় এবং সেখানকার আজকের ‘আজাদি’র সংগ্রামও মূলত ওই কৃষিসংস্কারকে কেন্দ্র করেই প্রথম দানা বেঁধেছিল।
প্রবল সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ রয়েছে এমন সমাজে ভূমি ও কৃষির সংস্কার প্রকৃতই এক বিপ্লবী রূপান্তর এবং রুশ বিপ্লবের প্রভাবে কাশ্মীরের মুসলমানপ্রধান সমাজে মুসলমান নেতৃত্ব তাই করতে পেরেছিল। প্রাচ্যের মুসলমান নেতৃত্ব সমাজের বিপ্লবী রূপান্তর ঘটাতে সমর্থ নয়, আরো কয়েকটি দেশের পাশাপাশি কাশ্মীরের অভিজ্ঞতা সেই ধারণারও খণ্ডন।
কাশ্মীরের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক দলিলগুলোর একটি হলো ‘নয়া কাশ্মীর’ মেনিফেস্টো। প্রায় ষাট বছর পুরোনো হলেও এই দলিলটি এখনো কাশ্মীরিদের স্বপ্নের প্রতীক। ১৯৪৪ সালের ৩১ জুলাই জম্মু ও কাশ্মীরের শাসক মহারাজা হরি সিং শ্রীনগর এলে শেখ আবদুল্লাহ ৪৪ পৃষ্ঠার এই মেনিফেস্টো তাঁর হাতে তুলে দেন। জম্মু ও কাশ্মীর তখন ব্রিটিশ অধীন একটি প্রিন্সলি এস্টেট। ‘নয়া কাশ্মীর’ মেনিফেস্টোর মাধ্যমে ভারত বা পাকিস্তানে যুক্ত না হয়ে কাশ্মীরের জন্য একটি স্বাধীন ভবিষ্যতের রূপকল্প ছিল। এতে প্রস্তাব করা হয়েছিল, জম্মু ও কাশ্মীর হবে একটি স্বাধীন সেক্যুলার রাষ্ট্র, যেখানে রাজা শুধু সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে থাকবেন। রাষ্ট্রটি পরিচালনা করবে একটা মন্ত্রিপরিষদ, যারা জবাবদিহি করবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়ে ওঠা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির কাছে। প্রত্যেক ৪০ হাজার নাগরিক একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত করে অ্যাসেম্বলিতে পাঠাবে। নতুন এই রাষ্ট্রে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা থাকবে এবং প্রত্যেক নাগরিক ধর্ম, জাত ও লিঙ্গনির্বিশেষে সমান অধিকার ভোগ করবে। রাষ্ট্রে নাগরিকদের বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রয়োজনে অস্ত্র রাখার অনুমতি দেওয়া হবে তাদের। এই দলিলের সবচেয়ে র্যাডিক্যাল দিক ছিল ‘লাঙল যার জমি তার’ দাবি উত্থাপন। বস্তুত তখন উপমহাদেশজুড়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ বয়ে গেলেও অন্যত্র মূলধারার দলগুলোর নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে ‘লাঙল যার জমি তার’-ধর্মী দাবি উত্থাপনের নজির অতি বিরল।
উল্লেখ্য, নয়া কাশ্মীর মেনিফেস্টো তৈরির সময় স্থানীয় মহারাজার সঙ্গে আবদুল্লাহর সদ্ভাব ছিল। এই সদ্ভাবের মূলে ছিল আবদুল্লাহর সঙ্গে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নেতাদের বন্ধুত্ব (বিশেষ করে পণ্ডিত নেহরুর) এবং জিন্নাহর সঙ্গে বৈরিতা। আবদুল্লাহর সঙ্গে জিন্নাহর এই বৈরিতা তৈরি হয়েছিল জম্মু-কাশ্মীরে ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিপরীতে মুসলিম কনফারেন্সকে সমর্থন দেওয়ার মধ্য দিয়ে। এ সময় জিন্নাহ জম্মু ও কাশ্মীর এসে (মে ১৯৪৪, কাশ্মীরে জিন্নাহর তৃতীয় এবং শেষ সফর!) ৭৭ দিন থাকলেও আবদুল্লাহ-জিন্নাহ দূরত্ব আর কমেনি-বরং বেড়েছিল। কাশ্মীর সফরের চার বছর চার মাস পর জিন্নাহ মারা যান। আর জিন্নাহর মৃত্যুর প্রায় এক বছর আগেই ১৯৪৭-এর অক্টোবরে কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনী নামে।
যদিও মুসলিম লীগ তার জন্মের শুরু থেকে সমগ্র ভারতের মতোই কাশ্মীরের মুসলমানদের দুর্দশার কথাও তুলে ধরছিল, কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচি আকারে তা প্রথম ভালোভাবে তুলে ধরতে পেরেছিল শেখ আবদুল্লাহর নয়া কাশ্মীর মেনিফেস্টো। পরবর্তীকালে ১৯৪৬ নাগাদ মহারাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহর সুসম্পর্ক নষ্ট হওয়া মাত্রই শেষোক্তজন ‘নয়া কাশ্মীর’কে সামনে রেখে ‘কুইট কাশ্মীর’ তথা ‘আজাদি’র আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ভ্যালি জুড়ে যা আজও চলছে।
লক্ষণীয়, নয়া কাশ্মীর মেনিফেস্টো এমন একসময় তৈরি হচ্ছে, যখন দক্ষিণ এশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বাদে কোনো আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের এরূপ সুলিখিত দলিল থাকা এক বিরল ঘটনা ছিল এবং শেখ আবদুল্লাহ ১৯৪৭ সালেÿক্ষমতায় আসা মাত্র ‘নয়া কাশ্মীর’ দলিলের কৃষি ও ভূমিসংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করেন সামন্ত প্রভুদের কাছ থেকে সিলিং উদ্বৃত্ত জমি বাজেয়াপ্ত করার মাধ্যমে। পরে এসব জমি বর্গাচাষি ও ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টিত হয়েছিল।
‘নয়া কাশ্মীর’ তথা সম্ভাব্য নতুন কাশ্মীরের সংবিধান তৈরিতে ১৯৪৪-এর পূর্বে এবং পরে অপ্রকাশ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ওই সময় আবদুল্লাহর কমিউনিস্ট বন্ধুরা। এঁরা ন্যাশনাল কনফারেন্সের অধীনেই কার্যক্রম চালাতেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপ্লব দ্বারা বিশেষ অনুপ্রাণিত ছিলেন। এই কমিউনিস্টরা মূলত কাশ্মীরের প্রতিবেশী পাঞ্জাবকেন্দ্রিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছিলেন এবং কাশ্মীরের দারিদ্র্যপীড়িত সমাজকে তাদের রাজনৈতিক কাজের জন্য একটি উত্তম ক্ষেত্র মনে করতেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ড. বাবা পিয়ারে লাল বেদি (অভিনেতা কবীর বেদির বাবা) এবং তাঁর বিদেশি স্ত্রী ফ্রেডা বেদি, মোহাম্মদ দীন তাসের, দানিয়েক লতিফী, আহসান দানিয়েশ, জি এম সাদিক প্রমুখ।
বাবা পিয়ারে লাল বেদি দক্ষিণ এশিয়ায় প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিপিএল বেদি নামেই অধিক পরিচিত। তিনিই প্রথম (১৯৩৫-৩৬-এ) লাহোরে সোভিয়েত রাজনৈতিক সাহিত্য মুদ্রণ ও প্রকাশ করেছিলেন ‘কনটেমপোরারি ইন্ডিয়া’ নামের প্রকাশনালয় থেকে। বস্তুত, বেদি ও উপরিউক্ত তরুণ কমিউনিস্টরাই সে সময় ‘নয়া কাশ্মীর’ দলিলটি তৈরি করে আবদুল্লাহর হাতে দেন এবং আবদুল্লাহ তা ন্যাশনাল কনফারেন্সের অনুমোদনের পর মহারাজার কাছে উত্থাপন করেন। এই দলিল ব্রিটিশদের যাওয়ার প্রাক্কালে ভারতে দুটি রাষ্ট্রের ধারণায় আপত্তি তুলে তিনটি বা ততধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলছিল। পাশাপাশি এই দলিলের অনেক কর্মসূচিই ছিল তখনকার সোভিয়েত রাজনৈতিক সাহিত্য থেকে নেওয়া। এমনকি এই দলিলের প্রচ্ছদটিও রাশিয়ার আদলে অঙ্কিত ছিল।
এ বিষয়ে সম্প্রতি বিস্তারিত এক গবেষণা তুলে ধরেছেন বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের একসময়ের নিউজ এডিটর অ্যান্ড্রু হোয়াইটহেড তাঁর লেখা বিপিএল বেদির স্ত্রী ফ্রেডা বেদির জীবনীতে। হোয়াইটহেড দীর্ঘদিন কাশ্মীরে কাজ করেছেন এবং তাঁর গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, ‘নয়া কাশ্মীর’ দলিলটি ছিল মূলত ছিল স্থানীয় শিরোনামে একধরনের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো। শিল্প ও জমির মালিকানা, নারীর অধিকার, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে এই দলিলে যেসব প্রস্তাব করা হয় তা ছিল তখনকার রুশ সংবিধানের মতোই। হোয়াইটহেড তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে পি এন জালালির ১০ বছর আগে নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের কথা বলেছেন। প্রাণনাথ জালালি ছিলেন বিপিএল বেদির অন্যতম সহযোগী। বস্তুত, ১৯৩০-এর দশকের শেষ পর্যায়ে আবদুল্লাহ রাজনৈতিক ভূমিকার ক্ষেত্রে যে পুরোপুরি বেদি এবং তাঁর কমিউনিস্ট বন্ধুদের দ্বারা তথা রুশ বিপ্লবের ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছিলেন, তার আরও সমর্থন মেলে ভারতে কাশ্মীর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক হিসেবে স্বীকৃত বলরাজ পুরির গবেষণাতেও।
ফ্রেডা বেদি ও বাংলার দুর্ভিক্ষ
হোয়াইটহেড ‘নয়া কাশ্মীর’ সম্পর্কে উপরিউক্ত তথ্যাবলি দিলেও তাঁর গবেষণা মূলত দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতির অন্যতম বিদেশি নারী চরিত্র ফ্রেডা বেদিকে নিয়ে। হোয়াইটহেডের মতে ফ্রেডা বেদি (জন্ম ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১১) ছিলেন অক্সফোর্ডে কোনো ভারতীয়কে বিয়ে করা প্রথম নারী। এরূপ আন্তধর্মীয় বিয়ে এখন গতানুগতিক বিষয় হলেও ফ্রেডা ও বিপিএলের বিয়ের খবর ‘অক্সফোর্ড মেইল’-এর প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল। ডার্বিশায়ার থেকে অক্সফোর্ডে আসা ফ্রেডার সঙ্গে পিয়ারি লালের প্রেম ও বিয়ে ১৯৩৩-৩৪-এ। এ সম্পর্কের সূত্রও ছিল রাজনৈতিক। অক্সফোর্ডে এরা ‘অক্টোবর ক্লাব’ এবং ‘মজলিশ’ নামে কয়েকটি অনানুষ্ঠানিক গ্রুপের সদস্য ছিলেন, যেসব গ্রুপ তখন সমাজতন্ত্র ও ভারতীয় স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালাত।
ফ্রেডার চেয়ে দুই বছরের বড় বিপিএল বেদি ছাত্রাবস্থাতেই ছিলেন কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন এবং পাঞ্জাব ও কাশ্মীরকেন্দ্রিক তখনকার ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতির অন্যতম সক্রিয় একজন। বিয়ের পর ফ্রেডা বেদি স্বামীর আদর্শতাড়িত রাজনীতিতে বাড়তি মাত্রায় শরিক হয়ে যান। বিশেষ করে বিপিএল লন্ডন থেকে বার্লিন হয়ে স্থায়ীভাবে লাহোর ফিরে এলে ফ্রেডাও বিপিএলের সঙ্গে কাশ্মীরের রাজনৈতিক আন্দোলনে শরিক হন। পাঞ্জাবের অনেক কমিউনিস্ট তখন কাশ্মীরকে তাঁদের আদর্শচর্চার এক ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এর দারিদ্র্যক্লিষ্ট অবস্থা দেখে। কালক্রমে ফ্রেডাও এঁদের সঙ্গে যুক্ত হন এবং একপর্যায়ে ১৯৪১-৪২-এ গ্রেপ্তার হন। ধারণা করা হয়, ফ্রেডা হলো উপমহাদেশের কোন অঞ্চলের রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে কারাবরণকারী প্রথম ব্রিটিশ নারী। লাহোর কারাগারে ফ্রেডাকে সন্তানসহ বন্দী থাকতে হয় কিছুদিন। এ সময় তিনি ছিলেন অল্প বয়সী এক সন্তানের জননী। শৈশবেই কারাজীবনের অভিজ্ঞতা পাওয়া ফ্রেডার সেই সন্তান হলেন রাঙা বেদি—খ্যাতনামা চিত্রনায়ক কবীর বেদির বড় ভাই।
লাহোরের ওই কারাজীবনেই ফ্রেডার সঙ্গে পরিচয় হয় মোহন দাস গান্ধীর। এই সাক্ষাৎ ফ্রেডাকে কাশ্মীর তথা ভারতের তখনকার জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে আরও সংশ্লিষ্ট করে তোলে। গান্ধী বিশেষভাবে ফ্রেডাকে তাঁর সত্যাগ্রহের আদর্শে প্রভাবিত করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
লাহোর কারাগারে কয়েক মাসের কারাজীবন শেষে ফ্রেডা বিপিএলের সঙ্গে লাহোর থেকে পুরোপুরি কাশ্মীর চলে আসেন। এ সময় তিনি শ্রীনগরে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনার চাকরি নেন, মানুষের সঙ্গে মেলামেশার তাগিদ থেকে স্থায়ীভাবে তাঁর পশ্চিমা বেশভূষা ত্যাগ করে স্থানীয় পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে যান এবং স্বামী-স্ত্রী দুজনই তাঁরা শেখ আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগীতে পরিণত হন। এমনকি আজাদির সংগ্রামের অংশ হিসেবে সে সময় কাশ্মীরে যে সশস্ত্র মিলিশিয়া গড়ে উঠছিল, ফ্রেডা তাতেও যে শরিক ছিলেন, সে বিষয়ে ফটোগ্রাফিক প্রমাণ মেলে। ইতিহাসের এ সময়টিতেই শেখ আবদুল্লাহর কমিউনিস্ট বন্ধুদের দ্বারা ‘নয়া কাশ্মীর’ দলিলটি লিখিত হচ্ছিল। তবে এরই ফাঁকে ১৯৪৪-এর জানুয়ারিতে ফ্রেডা বাংলায়ও আসেন। এর আগের বছরই বাংলায় ইতিহাসের কুখ্যাত দুর্ভিক্ষ ঘটে গিয়েছিল, যাতে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ মারা যায় এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরবর্তীকালের ড্রয়িংয়ের সূত্রে যার ভয়াবহতা খানিকটা আমরা জানি।
১৯৪৪-এর ওই সফর শেষেই ফ্রেডা বেদি লিখেন, বাংলার দুর্ভিক্ষ সাহিত্যের সাড়া জাগানো সরেজমিন দলিল ১১৩ পৃষ্ঠার ‘বেঙ্গল লামেন্টিং’ (বাংলায় শোকের মাতম)। পাঞ্জাবের বিখ্যাত চিত্রকর শোভা সিংয়ের প্রচ্ছদে যা প্রকাশিত হয় লাহোরের দ্য লায়ন প্রেস থেকে। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের ওপর এত হৃদয়বিদারক অনুসন্ধানী বর্ণনা উপমহাদেশে কমই লিখিত হয়েছে সে সময়। ফ্রেডা সে সময় পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছেন দীর্ঘ কয়েক সপ্তাহ ধরে। দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনার পাশাপাশি ব্রিটিশ এই নারী একই সঙ্গে এই দুর্ভিক্ষের প্রতি তৎকালীন শাসক ও সুশীল সমাজের উদাসীনতারও বর্ণনা দিয়েছেন আলোচ্য গ্রন্থে।
উল্লেখ্য, বিপিএল ও ফ্রেডা লাহোরে থাকাকালে রাজনীতির পাশাপাশি সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন। সে সময় তাঁরা অনেক গ্রন্থও প্রকাশ করেন। যার মধ্যে ছিল রুশ সংবিধান ও স্তালিনের অনেক বক্তৃতাও। ফ্রেডার দুর্ভিক্ষ-সংক্রান্ত গ্রন্থটিও প্রথম প্রতিবেদন আকারে পাঞ্জাবের দ্য ট্রিবিউন থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।
তবে, শেষ জীবনে বিপিএল ও ফ্রেডার জীবনযাপন অনেকখানি আধ্যাত্মিক অভিমুখে ধাবিত হয়। ১৯৬৬ নাগাদ ফ্রেডা তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে একজন নারী ভিক্ষুর জীবন বেছে নেন আর বিপিএল বিভিন্ন সময় প্রায় ১৫ বছর কারাবরণ শেষে তাঁর শিখধর্মীয় সাধনায় অধিক মনোনিবেশ করেন। ১৯৯৩ সালে বিপিএল মারা যান। এর ১৬ বছর আগেই ১৯৭৭-এর ২৬ মার্চ মারা গিয়েছিলেন ফ্রেডা। আর উভয়ের মৃত্যুর মাঝখানের সময়টিতে অবসান ঘটে রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের। তবে কাশ্মীরে আজও আজাদির আন্দোলনকে দিকনির্দেশনা দিয়ে চলেছে ঐতিহাসিক সেই মেনিফেস্টো, যা তৈরিতে বেদি দম্পতি ও তাঁদের সহযোগীদের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল অক্টোবর বিপ্লবের আদর্শ।
আলতাফ পারভেজ : দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক