বছর শেষ হতে চলল। ২০১৭ সাল সারা বিশ্বের জন্যই চড়াই-উতরাইয়ের বছর হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করে নিয়েছে। আর এই বিস্তর চড়াই-উতরাইয়ের কেন্দ্রে ছিল আমেরিকা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষেক থেকে শুরু করে তাঁর গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং তাঁকে ঘিরে বিভিন্ন ঘটনা কি ঘরে কি বাইরে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। সঙ্গে ছিল প্রকৃতির খামখেয়ালি আচরণ এবং সন্ত্রাসী হামলা ও বন্দুকযুদ্ধের মতো ঘটনা। নতুন করে প্রকট হয়ে সামনে এসেছে বর্ণবাদের মতো ঘটনাও। এই বছরই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিতকরণে আইন পাস করেছে কংগ্রেস। গাঢ় হয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলে কূটনৈতিক সংকট, যার পেছনে আবার কাজ করেছে মার্কিন নীতি-কৌশল। সব মিলিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার আগমুহূর্তে প্রথম আলোর দৃষ্টিতে আমেরিকার শীর্ষ ১০ ঘটনাকে তুলে ধরেছেন ফজলুল কবির
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক নিজেই একটি বড় ঘটনা। নির্বাচনী প্রচারের সময় দেওয়া বিভিন্ন বিতর্কিত প্রতিশ্রুতির কারণেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের দায়িত্ব নেওয়াটা সবার মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসে। আর সবাইকে অনেকটা আশ্বস্ত করতেই যেন অভিষেকের পরদিন বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রেস সচিব শন স্পাইসার ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানের জমায়েতকে ‘সর্বকালের সবচেয়ে বড়’ জমায়েত হিসেবে দাবি করে বিতর্কের জন্ম দেন।
যদিও সদ্য সাবেক বারাক ওবামার প্রথম মেয়াদের অভিষেক অনুষ্ঠানেই ছিল এর চেয়ে বেশি মানুষের জমায়েত। শুধু তাই নয়, অভিষেক চলাকালেই আশপাশের এলাকায় শুরু হয় ট্রাম্পবিরোধীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খণ্ডযুদ্ধ। বিস্তর ভাঙচুর করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় দুই শতাধিক বিক্ষোভকারীকে। এদিকে অভিষেক অনুষ্ঠানের আগেই ‘ভোট কারচুপি’র তদন্তের দাবি ওঠে। আর অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় ‘নট মাই প্রেসিডেন্ট’ হ্যাশট্যাগ।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে যুদ্ধংদেহী বক্তব্য দিয়ে আসছেন ট্রাম্প। আর এর উত্তর হিসেবে ৪ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসে উত্তর কোরিয়া একটি আন্তমহাদেশীয় ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়। আলাস্কায় আঘাত হানতে সক্ষম এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষাকে স্বাধীনতা দিবসে আমেরিকাকে পিয়ংইয়ংয়ের উপহার হিসেবে বর্ণনা করেন দেশটির নেতা কিম জং উন। এর তিন সপ্তাহ পর আরেকটি আন্তমহাদেশীয় ব্যালাস্টিক মিসাইল পরীক্ষা চালায় উত্তর কোরিয়া।
এমন পরিস্থিতিতেও টুইটারে বিভিন্ন বিস্ফোরক মন্তব্য করে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলেন ট্রাম্প, যা নিয়ে বিশ্বনেতারা ব্যাপক সমালোচনা করেন। পুরো বছরজুড়েই পিয়ংইয়ং-ওয়াশিংটন উত্তেজনা ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। বছরজুড়েই ছিল দুই দেশের দুই নেতার মধ্যে কথার লড়াই। উন ট্রাম্পকে অভিধা দিয়েছেন ‘বুড়ো ভাম’ বলে। প্রত্যুত্তরে ট্রাম্প উনকে আখ্যা দিয়েছেন ‘লিটল রকেটম্যান’ হিসেবে।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্সি বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে আছে নারী অধিকারকর্মীদের সোচ্চার আন্দোলনের দ্বারা। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্যাপিটল হিলের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পরদিনই আমেরিকার বিভিন্ন শহরে কয়েক মিলিয়ন মানুষ পথে নেমে আসে ‘উইমেনস মার্চে’ অংশ নিতে। আমেরিকার ইতিহাসেই এটি সবচেয়ে বড় এক দিনের বিক্ষোভ। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর হিসাবে আমেরিকাজুড়ে এদিন একই দাবিতে অন্তত ৬৫৩টি মিছিল হয়েছে, যেখানে প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ অংশ নিয়েছে। মূলত নারীর প্রতি অবমাননাকর বিভিন্ন বক্তব্যের কারণেই ট্রাম্পের অভিষেককে কেন্দ্র করে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল সচেতন মানুষেরা।
দক্ষিণে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের আগেই নিজের অভিবাসনবিরোধী মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি এই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় শুরু থেকেই কাজ শুরু করেন। ২৭ জানুয়ারিতেই সাত মুসলিম দেশের নাগরিকদের ওপর আমেরিকা ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে একটি নির্বাহী আদেশে সই করেন। দীর্ঘ সময়ের জন্য শরণার্থী গ্রহণ বন্ধের ঘোষণাও আসে। এই পদক্ষেপ বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্য থেকে আইনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও ট্রাম্প প্রশাসন নিজের পথেই অবিচল থাকে। এর প্রতিবাদে আমেরিকা ও আমেরিকার বাইরে বিস্তর সমালোচনা। অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের বিধান দিয়ে রায় দেন।
এদিকে আমেরিকায় প্রবেশে যেকোনো দেশের নাগরিকদের জন্যই যাচাই-বাছাইপ্রক্রিয়া কঠোর করা হয়। অনিবন্ধিত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এজেন্টদের অভিযান ব্যাপক জোরদার করা হয়। গণবিতাড়ন শুরু হয়। আর সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে এসে অনিবন্ধিত তরুণ অভিবাসীদের জন্য বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা ডিএসিএ (ড্রিমার অ্যাক্ট নামে পরিচিত) বাতিল করা হয়। এমনকি চতুর্দশ সংশোধনী বাতিল করে জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিকের বিধানটি সংবিধান থেকে বাদ দেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
পুরো বছরজুড়েই আমেরিকা কেঁপে উঠেছে একের পর এক বন্দুক ও সন্ত্রাসী হামলায়। গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের তথ্যমতে, ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত আমেরিকায় মোট ৩১৭টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে ১ অক্টোবর লাস ভেগাসে। ৬৪ বছর বয়সী এক ব্যক্তির চালানো বন্দুক হামলায় নিহত হয় ৫৮ জন। ৫ নভেম্বর সাদারল্যান্ডের একটি গির্জায় আরেক বন্দুক হামলায় নিহত হন ২৬ জন। এ ছাড়া নিউইয়র্ক শহরে ট্রাক হামলা এবং সর্বশেষ চলতি মাসে সাবওয়ে স্টেশনে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ১১ ডিসেম্বর চালানো সাবওয়ে হামলায় কেউ নিহত না হলেও প্রথমবারের মতো হামলাকারীর তালিকায় নাম ওঠে এক বাংলাদেশির।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের পর থেকেই নির্বাচনী প্রচার এমনকি ভোট ব্যবস্থায় রুশ হস্তক্ষেপের বিষয়টি আলোচনায় ছিল। এটি সবার মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসে গত ৯ মে। ওই দিন বরখাস্ত হন এফবিআই পরিচালক জেমস কোমি যিনি ট্রাম্পের তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিনের বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করছিলেন। ১৭ মে নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের বিষয়ে তদন্তের ভার দিয়ে বিশেষ কাউন্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় সাবেক এফবিআই পরিচালক রবার্ট মুয়েলারকে। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত মুয়েলার ট্রাম্পের প্রচারশিবিরের চার সদস্যকে রুশ-সংশ্লিষ্টতা ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। ফ্লিন ছাড়াও এর মধ্যে রয়েছেন ট্রাম্পের সাবেক পররাষ্ট্রনীতি উপদেষ্টা জর্জ পাপাডোপোলোস, প্রচার দলের সাবেক চেয়ারম্যান পল ম্যানাফোর্ট, প্রচার কর্মকর্তা ও দীর্ঘদিনের সহকারী রিক গেটস।
২০১৭ সালে সারা বিশ্বই প্রত্যক্ষ করেছে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আমেরিকাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কি প্রাণহানি কি সম্পদহানি, দুই বিচারেই এসব দুর্যোগ ছিল প্রলয়ংকরী। গত আগস্টে এক টেক্সাসেই ঘূর্ণিঝড় হারভের কারণে মারা গেছে ৮৮ জন। ক্ষতি হয়েছে ১৫০-১৮০ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের সম্পদের। এরপর এসেছে ৫ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ইরমা ও মারিয়া। সেপ্টেম্বরে আঘাত হানা ইরমায় দ্বীপাঞ্চল বারবুডার ৯৫ শতাংশ ভবনই ধসে যায়, মারা যায় ৭২ জন। একই মাসের ২০ তারিখ পুয়ের্তো রিকোয় আঘাত হানে আরেক ঝড় মারিয়া। পুরো দ্বীপাঞ্চলটির বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধসিয়ে দিয়ে যায় ঝড়টি। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন মানুষ।
জেরুজালেম ঘোষণা…
এ বছর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আমেরিকা ক্রমাগত নিজেকে একঘরে করে নিয়েছে। এমন পদক্ষেপের মধ্যে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ট্রাম্পের জেরুজালেম ঘোষণা। ৬ ডিসেম্বর জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর বিরোধিতায় একটি প্রস্তাব ওঠে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। নিজের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে সেখানে ১৪-১ ভোটে প্রস্তাবটি বাতিল করতে পারলেও সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে আর শেষ রক্ষা হয়নি। জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন প্রতিনিধি নিকি হ্যালি ও স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও উত্থাপিত প্রস্তাব ১২৮-৯ ভোটে জয়ী হয়। এটি আমেরিকার জন্য বড়সড় কূটনৈতিক পরাজয় হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকেরা। এর আগে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্নতার সূচনা হয় প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে, যা চূড়ান্ত রূপ পায় ইউনেসকো থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণায়। এসবই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমেরিকাকে দুর্বল করেছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শার্লোটসভিলে কাণ্ড বর্ণবাদের নব
আগস্টজুড়ে আলোচনায় ছিল শার্লোটসভিলে ঘটে যাওয়া বর্ণবাদী সহিংসতার ঘটনা। ওই মাসের ১২ তারিখে ভার্জিনিয়ার শার্লোটসভিলের লি পার্কে একটি কনফেডারেট ভাস্কর্য ঘিরে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। উদারবাদী আন্দোলনকারীরা দীর্ঘদিন থেকেই দাস ব্যবসা ও বর্ণবাদী আচরণের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে রবার্ট ই লির ভাস্কর্য অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। আর ওই দিন এই ভাস্কর্য রক্ষায় লি পার্কে রণসজ্জা নিয়ে হাজির হয়েছিল হাজারো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা। একপর্যায়ে কট্টরবাদীরা উদারবাদী জমায়েতের ওপর হামলা চালায়। মুহূর্তেই স্থানটিতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় নয়া-নাৎসিবাদী অ্যালেক্স ফিল্ডস আন্দোলনকারীদের ওপর গাড়ি তুলে দিলে নিহত হন হেদার হায়ের নামের ৩২ বছর বয়সী এক আন্দোলনকারী। এ ঘটনায় প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে দায়িত্বপূর্ণ বক্তব্য আশা করলেও উভয় পক্ষকে দোষারোপ করে দেওয়া তাঁর টুইটার পোস্ট সবাইকে স্তম্ভিত করে দেয়।
চলতি বছর বিষয়টি দারুণভাবে আলোচনায় এলেও ২০০৬ সালেই নারীর প্রতি যৌন হয়রানি বন্ধে সচেতনতামূলক প্রচারের অংশ হিসেবে ‘মি টু’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন নিউইয়র্কের নারী অধিকারকর্মী তারানা বার্ক। সে সময় বিষয়টি তেমন নজরে না এলেও চলতি বছর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে বিষয়টি রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায়। এ বছর বিষয়টি প্রথম সামনে আসে হলিউডে ঘটে চলা যৌন নিগ্রহের ঘটনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ১৫ অক্টোবর নারী অধিকারকর্মী এলিসা মিলানো টুইটার পোস্টে নিগ্রহের শিকার সবাইকে ‘মি টু’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহারের আহ্বান জানান। এক দিনের মধ্যেই ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া পড়ে। ৮৫টি দেশের মানুষ এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। এই আন্দোলন এতটাই প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছে যে, চলতি বছরের সেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে এবার কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম ঘোষণার বদলে টাইম ম্যাগাজিন এই ‘মি টু’ ক্যাম্পেইনকেই সেরার স্বীকৃতি দিয়েছে।