ম্যাচ নয়, টেস্ট ক্রিকেট বাঁচানোর দায়িত্ব নিয়েছে বাংলাদেশ!

আপডেট: ২০১৮-০২-০৩ ২২:১৬:৫৫


playজহুর আহমদ চৌধুরী স্টেডিয়ামটা চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে। কেউ বলে না দিলেও বোঝা যায়, এখানে পাহাড় ছিল অনেক। মানুষের বড় সর্বনাশা ক্ষুধা। সে পাহাড়ও গিলে খায়। এখানকার অনেক পাহাড় এখন অদৃশ্য। কোনো পাহাড় হয়তো নামে আছে, চোখে দেখা যায় না। এ রকমই একটা পাহাড়ের নাম ৭১৩/৯ ডি। না, নৃ বা ভূ-বিজ্ঞানীদের দেওয়া সাংকেতিক নাম নয়। ওটা শ্রীলঙ্কার তোলা প্রথম ইনিংসের রান।

২০০ রানের লিড নিয়ে ইনিংস ঘোষণা করেছে শ্রীলঙ্কা। টেস্ট ক্রিকেট বড় বড় স্কোর কম দেখেনি। তবে টেস্ট ইতিহাসে ৮ হাজার ২৪৬ ইনিংসের মধ্যে সাত শ পেরিয়েছে মাত্র ২৩টি। স্টেডিয়ামের জায়গাটাকে পাহাড়তলি না বলে সাগরিকা বলাই নাকি ভালো। শ্রীলঙ্কার এই ইনিংসটাকে পাহাড় না সাগরের সঙ্গে তুলনা করবেন, সেটা আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন।

২০০ ওভারের ফিল্ডিং পাহাড়ে ওঠার ক্লান্তি এনে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। তারই সুবাদে প্রায় সাড়ে ১১টি বিরক্তিকর সেশন কাটানো এই টেস্ট কাল হাজির হবে রোমাঞ্চকর ক্রিকেট উপহার দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে।

আর এই পুরো কৃতিত্ব বাংলাদেশের। বাজে ক্রিকেটের বিজ্ঞাপন হয়ে উঠতে থাকা চট্টগ্রাম টেস্টটাকে ভালো বানানোর দায়িত্ব যে বাংলাদেশই নিয়েছে। ৮১ রানে ৩ উইকেট নেই। ইমরুল-তামিমের পর দিনের শেষ বলে ফিরেছেন আগের ওভারটিকে বিলম্বিত করে দিন পার করার কৌশল নেওয়া মুশফিকও।

গত বছরের জানুয়ারিতে ৫৯৮ রান তুলেও হেরেছিল বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে সর্বোচ্চ রান তুলে ম্যাচ হারার বিশ্ব রেকর্ড ছিল সেটি। ২০১২ সালে ঢাকায় ৫৫৬ রান করেও হারার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের আছে। ৫০০-র বেশি করে ম্যাচ হারাটা নতুন নয়। কিন্তু তাই বলে এই টেস্টে!

৭ উইকেট নিয়ে কাল ৯০ ওভার পাড়ি দিতে হবে। ৭ উইকেট যত বড় শোনাচ্ছে, তত বড় কিন্তু মোটেও নয়। মুমিনুল আর মাহমুদউল্লাহ ছাড়া ভরসা করার মতো আর কেউ নেই সাকিববিহীন এই একাদশে। মোসাদ্দেক যদি তাঁর অভিষেক ইনিংসটা আবার মনে করিয়ে দিতে পারেন, তাহলে অন্য কথা। প্রতিপক্ষ ছিল শ্রীলঙ্কাই, বাংলাদেশের শততম টেস্ট ম্যাচে ঐতিহাসিক জয়ে কলম্বোয় ৭৫ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলেছিলেন মোসাদ্দেক।
সেবার বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে ছিলেন হাথুরুসিংহে। শ্রীলঙ্কা যে তাঁকে পেতে মরিয়া হয়ে উঠল, তাতে সেই জয় বড় ভূমিকা রেখেছিল। এবার লঙ্কানদের হয়ে বাংলাদেশকে ভোগাচ্ছেন এই কোচ। ঢাকায় ওয়ানডে ফাইনালে তবু বাজে উইকেটকে দায় দেওয়া গিয়েছিল। এখানে খেলা হলো এমনই এক ম্যাড়ম্যাড়ে উইকেটে, ১১ সেশনে রান উঠেছে ১২১৮, উইকেট পড়েছে ১৭টি।

সেশন–প্রতি গড়ে দেড়টি করে উইকেট পড়েছে কি পড়েনি। উইকেট যেখানে ভীষণ দুষ্প্রাপ্য বস্তু হয়ে উঠেছিল, সেখানেই শেষ সেশনে পড়ল ৫ উইকেট! হাথুরু এখানে এমন কোনো ভোজবাজি করেছেন বলেও মনে হলো না। এই উইকেটে করার কীই-বা ছিল! গ্যালারিতে ঘুমপাড়ানি দর্শকদের বেশ কয়বার দেখাও গেছে টিভি পর্দায়। সাংবাদিকেরা কাজ খুঁজে না পেয়ে গান-টান করে বেড়ালেন গিটার বাজিয়ে। ম্যাড়ম্যাড়ে ম্যাচ নিয়ে যে কারও কোনো আগ্রহ নেই।

দায়িত্ব তাই কাঁধে তুলে নিল বাংলাদেশ দল। বিশ্বজুড়েই টেস্ট ক্রিকেটের দর্শক হু হু করে কমছে। দক্ষিণ আফ্রিকা-ভারতের মতো সিরিজেও কোনো কোনো দিন গ্যালারির শূন্যতা দেখে টেস্ট-প্রেমীদের বুক খাঁ খাঁ করছিল। টি-টোয়েন্টির ‘মার ঘুরিয়ে’র ডিজে গানটার বাজনাদারে যখন টেস্টের ধ্রুপদ সুরটা ফিকে হতে বসেছে, সেই সময় চট্টগ্রাম টেস্টটা বাজে বিজ্ঞাপনই হয় উঠছিল। টেস্ট তখনই জমবে, ব্যাটে-বলের লড়াইটা যখন হবে টায়ে টায়ে।

বাংলাদেশ তাই শেষ সেশনে খেলল টেস্ট ক্রিকেট বাঁচানোর মহান দায়িত্ব নিয়েই। অন্তত ইমরুলের সুইপটার আর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। হেঁয়ালি ভঙ্গিতে খেললেন এমন সময়ে, দুই শর লিডটাকে বাংলাদেশ বিনা উইকেটে ১৪৮-এ নামিয়ে এনে উইকেটটাকে চতুর্থ দিনেও মহা ব্যাটিং-বান্ধব বলেই প্রমাণ করছিল। এই ম্যাচের ভাগ্যে তখন একটাই ফল মনে হচ্ছিল: ড্র।

কিন্তু ওই যে, ক্রিকেটের গৌরবময় অনিশ্চয়তার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিল বাংলাদেশ। তামিম-মুশফিকের বিদায়ে এই টেস্টে শ্রীলঙ্কা এখন পরিষ্কার ফেবারিট।

তামিমকে পুরো দায় দিলে সান্দাকানের এই উইকেটে বাঁক আদায় করে নেওয়া ডেলিভারিটির প্রতি অন্যায় করা হয়। কিন্তু এত বাইরের বল তামিম খেলতে যাবেনই বা কেন। তামিম-ইমরুল অহেতুক আক্রমণাত্মকের দোষে দোষী হলে মুশফিকের দায় রক্ষণাত্মক খেলার। দিনের শেষ ওভারের আগের ওভারে চিকিৎসা-বিরতি নেওয়া মুশফিকের সময়ক্ষেপণের ছাপ থাকল নেতিবাচক ব্যাটিংয়েও।

টেকনিকে দেশের সেরা ব্যাটসম্যান যদি দেয়াল না তুলতে পারেন, তুলবে কে। লঙ্কান আবেদনে নাকচ করে, সফট সিগন্যালে নটআউট দেখিয়ে মাঠের আম্পায়ার গিয়েছিলেন রিভিউয়ে। মুশফিক বাঁচতে পারলেন না। মুশফিক-ইমরুলরা এও হয়তো বোঝাতে চাইলেন, বাপু এর নাম টেস্ট ক্রিকেট। দেখেছ আক্রমণ আর রক্ষণে ভারসাম্য আনতে না পারলে কী হয়। অলআউট হতে কিন্তু মাত্র ১০টা বলই লাগে।

বাংলাদেশের খাতায় এমন তিনটা বল এরই মধ্যে খরচ হয়েই গেছে। আর এমন সাতটি বলের অপেক্ষায় শ্রীলঙ্কা। কাল শেষ দিনে অপেক্ষা করছে ৫৪০টি বল। ভাবতেই তো বুক কাঁপছে। প্রতিটা বলেই থাকবে রোমাঞ্চ! মরা একটা টেস্টের রং দিনের শেষ ১২ ওভারে বদলে ফেলার কৃতিত্ব বাংলাদেশকে কি দেবেন না? নাকি বলবেন, এর থেকে মরা ক্রিকেটই ভালো!