দুর্নীতিবাজদের অবশ্যই বিচার হবে: প্রধানমন্ত্রী
প্রকাশ: ২০১৮-০২-১৪ ২৩:৩৮:২৪
সরকার তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা কোনো মামলা প্রত্যাহার করেনি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে যারা দুর্নীতি, সন্ত্রাস করবে এবং জঙ্গিবাদে জড়াবে তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা দেশে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই। আমরা দেশকে উন্নত এবং জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে চাই। এটা তখনই সম্ভব হবে, যখন আমরা দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ ও স্বজনপ্রীতি নিয়ন্ত্রণ এবং অপসারণ করতে পারব।’
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মঙ্গলবার রাতে রোমের পার্কো দ্য প্রিনসিপি গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড এসপিএতে আওয়ামী লীগের ইতালি শাখা আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন। খবর বাসসের।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আদালত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন, যে মামলা ১০ বছর ধরে চলেছে। এখানে আমাদের তো করার কিছু নেই। আর আমরা যদি করতামই তাহলে ১০ বছর তো চলতে দিতাম না। ২০০৮ সালে যখন ক্ষমতায় আসলাম, তখনই তো শেষ করতে পারতাম।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিরুদ্ধে অতীতে দায়ের হওয়া দুর্নীতির মামলা প্রসঙ্গে বলেন, তিনি আগেই প্রত্যেক মামলার তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য বলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি প্রত্যেকটি মামলার তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছিলাম। মামলাগুলোর প্রকৃত অবস্থা আমরা যাচাই করে দেখতে চেয়েছিলাম।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রত্যেকটি মামলার তদন্ত হয়েছে এবং এর রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে। আমি কোনো মামলা প্রত্যাহার করিনি এবং এর অনুমতিও দিইনি, কেন আমি এটা করব। আমি জানতাম, আমি তো কোনো দুর্নীতি করিনি।’
এ সময় প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘হিলারি ক্লিনটন সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এবং ড. মুহম্মদ ইউনূস সে সময় তাঁকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের দোষ ধরতে মুখিয়ে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ওই সময় তিন-তিনবার আমার ছেলেকে এ ব্যাপারে হুমকিও দেয়।’ তিনি বলেন, এটি কানাডার আদালতেই প্রমাণিত হয়েছে যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, আমি দুর্নীতি করার জন্য ক্ষমতায় আসিনি। আমি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই ক্ষমতায় এসেছি। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নয়।’
দেশের বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে আদালতে। আদালত যখন দেখেছে, বিএনপি নেত্রীর মাধ্যমে এতিমের টাকার সম্পূর্ণ অপব্যবহার হয়েছে, তখন আদালত তাঁকে এই শাস্তির রায় দেন। তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আমাকে তিরস্কার এবং সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার কী যুক্তি থাকতে পারে?’
ইতালি শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজি মোহাম্মদ ইদ্রিসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতারা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অপকর্মের কারণেই সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেই দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে। তিনি বলেন, ‘বিএনপি দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে, দুর্নীতি ও বাংলা ভাই সৃষ্টি করে এবং এই প্রেক্ষাপটেই আমরা জরুরি অবস্থা দেখেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে যে মামলায় খালেদা জিয়ার শাস্তি হয়েছে, সে মামলা কে দিয়েছে? খালেদা জিয়ার প্রিয় ব্যক্তিত্ব। ফখরুদ্দীন, মইন উদ্দিন, ইয়াজউদ্দীন-এই তিনজনই তো তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দিলেন। এ মামলা তো আওয়ামী লীগ দেয়নি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৭ সালে এই মামলা হয় এবং পরের বছরই এর বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। এই মামলা ১০ বছর ধরে চলে এবং মামলার শুনানির জন্য ২৩৬ কার্যদিবস ধার্য হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া আদালতে গেছেন মাত্র ৪০ দিন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, খালেদা জিয়ার আপত্তির কারণে এই মামলায় তিনবার আদালত পরিবর্তন করা হয় এবং তিনি এর বিরুদ্ধে ২২টি থেকে ২৪টি রিট করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনবার আদালত পরিবর্তন করে মামলাকে দীর্ঘায়িত করার পরেও যখন আদালত খালেদা জিয়াকে শাস্তি দিলেন, তখন বিএনপি এই স্বল্প পরিমাণ টাকার জন্য খালেদা জিয়াকে শাস্তি দেওয়ার যৌক্তিকতার প্রশ্ন তুলছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, যে টাকা খালেদা জিয়া এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অপব্যবহার করেছেন, সে টাকা এতিমদের জন্য এসেছিল। কিন্তু এতিমদের পরিবর্তে সে টাকা তাঁদের নিজেদের তহবিলে চলে যায়। বিএনপির নেতারা বলেন, সেই টাকা তাঁদের তহবিলে রাখার ফলে দুই কোটি থেকে বেড়ে তিন কোটি হয়েছে। কিন্তু এতিমেরা এ থেকে কী লাভটা পেল। তিনি বলেন, ‘যদি খালেদা জিয়া বলতেন, সেই টাকা তিনি তাঁর এতিম দুই পুত্রের জন্য রেখেছেন, তারও না হয় একটি যৌক্তিকতা ছিল।’
শেখ হাসিনা বলেন, যখন মামলাটি করা হয়, তখন ব্যারিস্টার রফিকুল হক বলেছিলেন, খালেদা জিয়া ওই পরিমাণ টাকা জমা করে দিলেই মামলাটি প্রত্যাহার হয়ে যাবে। কিন্তু তিনি (খালেদা জিয়া) টাকার মায়া ছাড়তে পারেননি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তখন টাকার যে মূল্য ছিল, তা থেকে এক কোটি টাকা দিয়ে তিনি চারটি ফ্ল্যাট কিনতে পারতেন, এটিই হচ্ছে বাস্তবতা। কাজেই তিনি টাকার মায়া ত্যাগ করতে পারেননি বলেই আজকে এতিমের টাকা আত্মসাতের কারণে তিনি কারাগারে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে যারা বিএনপি দরদি, আঁতেলরা আছে, তারা বলে দুই কোটি টাকার জন্য কেন এই মামলা। তাহলে আমার এখানে একটা প্রশ্ন আছে, দুর্নীতির করার জন্য কি একটা সিলিং থাকবে যে এত কোটি পর্যন্ত দুর্নীতি করা জায়েজ। তারা কি সেটা বলতে চায়?’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি তাহলে একটা দাবি করুক যে এত কোটি পর্যন্ত তারা দুর্নীতি করতে পারবে। সেটা নিয়ে একটা রিট করুক।’
রায় বাতিলের জন্য বিএনপির চলমান আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মেরেছে। তিনি বলেন, ‘বিএনপির একটি অভ্যাস আছে টাকা দিয়ে সবকিছু কিনে নেওয়ার কিংবা বিচারকদের দরজায় লাথি মারার এবং মাস্তানি করার, আমরা সেটা জানি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘খালেদা জিয়ার দুই ছেলে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। যাদের টাকা আমরা ফেরত এনেছিলাম। তারেকের বিরুদ্ধে এফবিআই আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে।’ বিএনপি-জামায়াত জোটের সীমাহীন দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা জনগণের জন্য কিছুই করেনি, শুধু ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ছাড়া। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘২০১৪ ও ২০১৫ সালে নির্বাচন প্রতিরোধ ও সরকার পতনের নামে এই বিএনপি জ্বালাও-পোড়াও ও অগ্নিসংযোগ করে। ২০১৩ সালে ঠিক একইভাবে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছিল।’
সরকার প্রধান বলেন, ওই সময়ে তারা (বিএনপি-জামায়াত জোট) আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। প্রায় তিন হাজারের ওপরে মানুষকে তারা আগুন দিয়ে ঝলসে দিয়েছে। ওই তিন বছরে প্রায় ৫০০ মানুষকে তারা হত্যা করেছে। পুলিশ, বিজিবি, সেনাসদস্যকে পুড়িয়ে মেরেছে। তিনি বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমান, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার এমপিসহ অসংখ্য নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উনি (খালেদা জিয়া) প্রধানমন্ত্রী হয়ে কালোটাকা সাদা করেছেন। এল কোথা থেকে এই টাকা। তাঁর সময় বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পর পর পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিশেষ করে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি এবং কূটনৈতিক খাতে সাফল্যের খণ্ড চিত্র তুলে ধরেন।
রেমিট্যান্স পাঠানোর মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবদানের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতেও তাঁদের বড় অবদান রয়েছে। তিনি এ সময় প্রবাসীদের কল্যাণে তাঁর সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপও তুলে ধরেন। ঢাকা-রোম সরাসরি বিমান ফ্লাইট পুনরায় চালুর প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি সরকারের দুর্নীতি এবং তাদের ভুল সিদ্ধান্ত বিমানকে (বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস) ধ্বংস করে দিয়েছে। লাভজনক হলে আমরা পুনরায় ঢাকা-রোম ফ্লাইট চালু করব।’
রাতে দেশের পথে যাত্রা করবেন প্রধানমন্ত্রী: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতালি ও ভ্যাটিকান সিটিতে তাঁর চার দিনের সরকারি সফর শেষে আজ বুধবার রাতে দেশের উদ্দেশে রোম ত্যাগ করবেন। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বহনকারী ইতিহাদ এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ স্থানীয় সময় রাত ১০টায় (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত তিনটা) রোমের লেওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ফিউমিসিনো বিমানবন্দর থেকে আবুধাবির উদ্দেশে যাত্রা করবে। ইতালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুস সোবহান সিকদার বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় জানাবেন।
দেশে ফেরার পথে শেখ হাসিনা সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে এক দিনের যাত্রাবিরতি করবেন। শুক্রবার সকাল আটটায় তিনি ঢাকা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন।
প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (ইফাদ) ৪১তম পরিচালনা পর্ষদের অধিবেশনে যোগ দিতে রোববার রোম পৌঁছান। শেখ হাসিনা পোপ ফ্রান্সিসের আমন্ত্রণে পোপের সঙ্গে বৈঠক করতে ভ্যাটিকান সিটি সফর করেন।