ফিলিস্তিনিদের রক্ত ও কান্নার শেষ কোথায়?
প্রকাশ: ২০১৮-০৪-০৩ ০১:৫১:৪১
ফিলিস্তিনিদের রক্ত ঝরছেই। কমবেশি প্রতিনিয়তই। আজকে গাজায় তো পরের দিন রামাল্লায়। এরপর হয়তো পশ্চিম তীরে। সর্বশেষ রবিবার পর্যন্ত গাজা-ইসারয়েল সীমান্তে ফিলিস্তিনিদের ‘ভূমি দিবস’ পালনকালে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ১৭ জন নিহত হয়েছে। ১৯৭৬ সালের ৩০ মার্চ ভূমি থেকে উচ্ছেদের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৬ নিরস্ত্র প্রতিবাদী ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনিরা এবার ৩০ মার্চ ঘিরে আয়োজন করেছিল মহাপ্রত্যাবর্তন মিছিলের। এই মিছিল নিজ পিতৃভিটার হারানো অধিকার ফিরে পাওয়ার মিছিল। নিরস্ত্র প্রতিবাদী মিছিলে গুলিবর্ষণ করে ইসরায়েলি বাহিনী। স্নাইপার দিয়েও প্রতিবাদীদের হত্যা করার অভিযোগ গণমাধ্যমে পাওয়া গিয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, তাঁর সৈন্যরা জানে, বুলেট–গুলি কোথায় বেঁধাতে হবে, তারা নাকি যা করেছে, ঠিকই করেছে।
ঘটনার পর বরাবরের মতো একই নাটক মঞ্চায়িত হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব লোকদেখানো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, যা বিবৃতি দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ কূটনীতিক ফ্রেডেরিকা মগহেরেনি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য বিবৃতি দিয়েছেন। সবকিছু যেখানে প্রকাশ্যে ঘটছে, সেখানে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি খুবই হাস্যকর বিষয়। অবশ্য জাতিসংঘ ও ইইউয়ের বেশি কিছু করার ইচ্ছা বা ক্ষমতাও নেই। ইসরায়েল আবার এই বিবৃতিও নাকচ করে দিয়ে বরং ঘটনার জন্য হামাসকে দায়ী করছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ইসরাইলকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বলে মন্তব্য করেছেন। এর সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলেছে ইরান ও লেবাননের হেজবুল্লাহ। আর বাকি বিশ্বনেতারা নিশ্চুপই আছেন। প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েল কর্তৃক পরিচালিত এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে কারও কোনো হেলদোল নেই। সবাই নীরবে প্রত্যক্ষ করছে। গণগত্যা, মানবাধিকার, যুদ্ধাপরাধ, মানবিক বিপর্যয়—সবকিছুই যেন ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের বেলায় অকার্যকর। অবশ্য ইসরায়েল নামক বিশ্বের প্রধানতম ধর্মভিত্তিক দখলদার রাষ্ট্রকে তো ১৯৪৮ সালেই মেনে নিয়েছে সবাই। প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের যাত্রাই শুরু হয়েছিল এই দখলদার রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদানের মধ্য দিয়ে। জাতিসংঘ আর ইসরায়েল সমবয়সী।
ফিলিস্তিনে মানবতার বিপর্যয় ও গণহত্যা আধুনিক সভ্যতার দীর্ঘস্থায়ী সংকট। কিন্তু দুনিয়া ফিলিস্তিনিদের ত্যাগ করল কেন? পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ইসরায়েলের দাবনীয় শক্তির কাছে সবাই যেন নতি স্বীকার করছে। ফিলিস্তিনিদের এই দুর্গতির জন্য হয়তো অনেক কারণই বিশ্লেষণ করা যাবে। তবে দুটি কারণ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, আরবদের মধ্যকার অনৈক্য ও গণতন্ত্রহীনতা। দ্বিতীয়টি ঐতিহাসিক: আরব-ইউরোপ দ্বন্দ। ঐতিহাসিক দ্বন্দের এই মঞ্চে আবার চরিত্রের বদল হয়েছে। প্রথমটি কারণটির সুযোগে মঞ্চের মধ্যমনি জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ও সমর্থক যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপ এখানে সহযোগী।
নানা অক্ষে বিভাজিত আরব এখন বেশির ভাগই অগণতান্ত্রিক শাসকদের নিয়ন্ত্রণে। একদিকে সিরিয়া, ইরান, লেবানন, অন্যদিকে সৌদি আরব, উপসাগরীয় দেশসমূহ ও মিসর। আরবদের মধ্যে বিরোধ এতটাই প্রবল যে প্রয়োজনে এরা ইসরায়েলেরে পক্ষ নিতেও লজ্জা পাচ্ছে না। সৌদি আরবই এর বড় উদাহরণ। অনৈক্যের কারণ; আরবের অধিকাংশ দেশেই গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। এই অগণতান্ত্রিক শাসকদের আবার টিকিয়ে রেখেছে পশ্চিমা শাসকেরা। স্মার্তব্য, আরবের যেই দেশগুলোয় কমবেশি নির্বাচনী চর্চা আছে, সেই দেশগুলোর সঙ্গে পশ্চিমের আবার সম্পর্ক খারাপ। যেমন লেবানন। লেবাননে কতটা গণতন্ত্র আছে, তার থেকেও মুখ্য হচ্ছে সেখানে নির্বাচন হয়। নির্বাচনের মাধ্যমেই খ্রিষ্টান ও মুসলমানরা ক্ষমতা ভাগাভাগি করছে। নির্বাচনমুখী লেবাননের হেবজুল্লাহদের পশ্চিমারা খুব একটা পছন্দ করেন না। অ-আরব ইরান ও তুরস্ক নিয়েও পশ্চিমাদের সমস্যা আছে। ইরান তুরস্কের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের নানাবিধ প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু মিসরের ক্ষেত্রে ভিন্ন। সেখানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়ে গেল। আগে মাত্র দুবার হয়েছে। মিসরের নির্বাচন স্বচ্ছ হয়েছে কি না, সিসি কোনো বলপ্রয়োগ করেছেন কি না, তা নিয়ে পশ্চিমের মুখে কোনো রা নেই। বরং ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা মিসেরর সামরিক শাসকদের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্ক বরাবরই উষ্ণ। কারণ, ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য মিসরকে হাতে রাখা খুবই জরুরি। পশ্চিমারা ইরান ও তুরস্কে বাক্স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের অধিকার নিয়ে যতটা উচ্চকিত, সৌদি আরব, মিসর বা উপসাগরীয় অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে ততটা সক্রিয় নয়। এখানেই আরবদের অনৈক্যের মূল খেলা। পশ্চিমারাই নিজ স্বার্থে চায় না আরবে গণতন্ত্র আসুক। কর্তৃত্ববাদী সিসি, বাদশাহরা টিকে থাকুক—এটাই পশ্চিমাদের চাওয়া। গণতান্ত্রিক আরবকে পশ্চিমাদের বড় ভয়। কারণ, আরবে যদি জনসাধারণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তা ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের স্বার্থের ক্ষতি হতে পারে।
এখানে পশ্চিমাদের স্বার্থ কোন জায়গায়? বর্তমান কারণ হচ্ছে দ্বিধাবিভক্ত আরবের তেলসম্পদ লুণ্ঠন। আর বর্তমানের সঙ্গে অতীতের সংযোগ করেছে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। বিশেষ করে ইসলামের আর্বিভাবের পর থেকেই আরব ও ইউরোপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলছে। উমাইয়া, আব্বাসি ও ওসমানীয়দের শাসনামলে আরবরা শক্তি সঞ্চয় করে বিভিন্ন সময় ইউরোপে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেছে। আবার এরও আগে রোমান সাম্রাজ্যের আমলে ইউরোপীয়রা আরব শাসন করেছে। যদিও কোনো পক্ষই কোনো অঞ্চল পুরোপুরি দখল করতে পারেনি। এশিয়া মাইনরকে ঘিরেই ছিল এ লড়াই। তবে কখনো কখনো এশিয়া মাইনর থেকে আরও বিস্তৃত হয়েছিল আধিপত্যের লড়াই। সম্রাট আগাস্টাস সিজারের সময় রোমানরা ইয়েমেন পর্যন্ত দখল করেছিল। মধ্যযুগে আরবরা একদিকে স্পেন ও অন্যদিকে অষ্ট্রিয়া পর্যন্ত চলে গিয়েছিল।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, গত শতকে আরবে তিনটি ঘটনা খুব কাছাকাছি সময়ে ঘটেছে। গত শতকের শুরু দিকেই ওসমানীয়দের পতন হয়েছে ইউরোপীয়দের হাতে। এর পরপরই ধর্মভিত্তিক ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ আসে পশ্চিমাদের সামনে। আবার এর কাছাকাছি সময়ে আরবের দেশগুলোয় তেলভান্ডার আবিষ্কৃত হয়। উমাইয়া, আব্বাসীয় ও ওসমানীয়দের হাত ধরে আরব যে শক্তিশালী রূপ ধারণ করেছিল, ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ওসমানীয়দের পতনের পরই আরবরা আবারও বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই বিভক্তি যেমন আরবদের দুর্বল করে দেয়, একই সঙ্গে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগমও করে দেয়।
পশ্চিমারা না হয় স্বার্থের কারণে ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে নির্লিপ্ত বা দেখেও না দেখার ভান করছে; কিন্তু অন্যরা কী করছে? নিকট প্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোও কখনোই কিছু বলেনি। বিশ্ব সমাজের এই নির্লিপ্ততার প্রভাব কী হতে পারে? ইতিহাসে কোনো ঘটনা একবার ঘটে গেলে তার আবারও পুনরাবৃত্তিও হয়। ইতিহাসের এই ফিরে আসা বক্রাকার না বৃত্তকার, এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে ফিরে আসে যদি না কোনো ন্যায্য সমাধান না করা হয়। ফিলিস্তিন সংকটের নানা সমাধান আমরা দেখেছি। বিভিন্ন রোডম্যাপ নিয়ে অনেক আলোচনা, বিতর্ক হচ্ছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই ওই অঞ্চলে শান্তি ফিরে আসবে, যদি না ফিলিস্তিনিদের ভূমির ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ইসরায়েলকে বিলুপ্ত করা না হয়। দুই রাষ্ট্র ধারণা থেকে সরে এসে এক রাষ্ট্র সমাধানের দিকে যেতে হবে। নতুবা আরবে শান্তি আসবে না। ফিলিস্তিন, আরবরা কি ধুলোয় মিশে যাবে? না। বরং শক্তি সঞ্চয় করে আবারও কোনো দিন ইউরোপে ঢুকে পড়বে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আরবের শক্তি আবারও ফিরে আসতে পারে। ক্ষমতা কখনো কোথাও চিরস্থায়ীভাবে কেন্দ্রীভূত থাকে না। সময়ের পরিক্রমায় এই শক্তি ও ক্ষমতা স্থানান্তরিত হয়। অন্তত ইতিহাস তেমনটিই সাক্ষ্য দেয়।
ড. মারুফ মল্লিক: রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেম্পোরারি কনসার্নস, জার্মানি।