দেশ ছাড়লেন বদি

প্রকাশ: ২০১৮-০৬-০২ ০৬:২১:৪৩


 

bodyমিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত উপজেলা কক্সবাজারের টেকনাফ। উপকূলীয় এই অঞ্চলই মিয়ানমার থেকে মরণ নেশা ইয়াবা আসার প্রধান রুট। আর এই মাদক ব্যবসা করে ফুলেফেঁপে ওঠা ব্যবসায়ীরা এখন রীতিমতো আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার বা ডন বনে গেছেন। খুচরা মাদক বিক্রেতা বা দেশের অভ্যন্তরে সরবাহকারী বা সেবনকারীদের কাছে এসব গডফাদার ‘বাবা’ নামে পরিচিত। এই বাবারা সাম্প্রতিক মাদকবিরোধী অভিযানে গা-ঢাকা দিয়েছেন। বেশিরভাগই পবিত্র ওমরাহ পালনের নামে সৌদি আরবে যাওয়ার কথা বলে দেশ ছেড়েছেন। এদের মধ্যে সর্বশেষ বহুল আলোচিত সরকারদলীয় সংসদ সদস্য (এমপি) আব্দুর রহমান বদি দেশ ছাড়লেন।

শুক্রবার ভোররাতে সৌদি এয়ারলাইন্সের বিমানে তিনি হযরত শাহাজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ওমরা পালনে সৌদি আরবের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন চট্টগ্রামের স্কুল বন্ধু নুরুল আকতার, গিয়াস উদ্দিন ও উখিয়ার হলদিয়া পালংয়ের মৌলানা আলী আহমদ নূরী। এর আগে গত ২৬ মে এমপি বদির মেয়ে সামিয়া রহমান ও জামাই ব্যারিস্টার রানা আশরাফ ওমরার উদ্দেশে সৌদি আরবে পাড়ি জমান।

এমপি বদির ব্যক্তিগত সহকারী হেলাল উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তার ভাষ্যমতে, মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে এমপি বদির হঠাৎ ওমরা পালনে সৌদি আরবে গমনকে অনেকে কৌশল হিসেবে মনে করলেও এটি সঠিক নয়। ওমরা পালনের সিডিউল অনেক আগেই নেওয়া ছিল। অভিযান শুরু হওয়ার পর ফ্লাইট হওয়ায় তিনি অভিযান থেকে বাঁচতেই ওমরায় চলে গেছেন বলে ধারণা করছেন অনেকে।

তিনি আরও বলেন, নিয়ম অনুযায়ী তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতিও নিয়েছেন এবং রমজানের শেষ সপ্তাহজুড়ে তিনি মসজিদ আল-হারামে ইতেকাফ করার নিয়ত করেছেন। ওমরা পালন শেষে ১৭ জুন দেশে ফিরবেন তিনি। গত এক রমজান থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে শুরু হওয়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানের পর থেকে বদির নামটি জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে সর্বত্র। প্রতিদিন মাদবিরোধী অভিযানের একাধিক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নিহত হচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। বদি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।

ইয়াবাসম্রাট হিসেবে বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়। মাদকবিরোধী অভিযানের আগে পাঁচটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার সমন্বয়ে মাদক ব্যবসায়ী ও পৃষ্ঠপোষকদের একটি তালিকা তৈরি করে সরকার। সেই তালিকায় মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আছে কক্সবাজার-৪ আসনের (উখিয়া-টেকনাফ) এমপি আব্দুর রহমান বদির নাম। এছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকায় এক নম্বরে আছে বদির নাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা টেকনাফের শীর্ষ মানব পাচারকারীর তালিকাতেও তার নাম ছিল। দেশে মাদক ইয়াবার গডফাদার ও ব্যবসায়ীর তালিকায় টানা ১০ বছর ধরে ছিল বদির নাম। কিন্তু গত মার্চ মাসে একটি সংস্থার তালিকা থেকে সেই নাম বাদ দেওয়া হয়। তবে সেই তালিকায় বদির পাঁচ ভাই, এক ফুফাতো ভাই, দুই বেয়াই ও এক ভাগ্নের নাম আছে। তালিকায় সব মিলিয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে কক্সবাজারের আট উপজেলার এক হাজার ১৫১ জনের নাম আছে।

এ ব্যাপারে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর অতি সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, টেকনাফ থানার ওসি আর বিজিবির এই ব্যাটালিয়নের কমান্ডারের সঙ্গে কথা বললেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে, তারাই বলে দেবে বাংলাদেশে ইয়াবা কে এনেছে। তিনি আরও বলেন, ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এমপি আছেন বদি। আমরা দেখি যারা ইয়াবা আমদানির মূল কারিগর, তারা সবাই এমপি সাহেবের আশেপাশে থাকে আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকে এমপি তাদের শেল্টার দেন। তাহলে মানুষ কী বুঝবে? আপনি টেকনাফের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। শতকরা ৯৫ জনই বলবেন এমপি বদির মাধ্যমেই ইয়াবা এসেছে বাংলাদেশে। অবশ্য এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। গতকাল শুক্রবার মুঠোফোনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বদির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ-সেটা ভাসা ভাসা। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে একজন সংসদ সদস্যকে ধরা যায় না। তিনি কারও কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকলে সরবরাহ করার অনুরোধ জানান। তার বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিদেশ যেতেই পারে। কারণ বদির দেশত্যাগে আদালতের বা সরকারের তরফ থেকে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

মরণ নেশা ইয়াবা বেচাকেনা করে কক্সবাজারের টেকনাফে রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি বানিয়েছেন অনেকে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব বাড়ি ছেড়ে তালিকাভুক্ত ‘বাবা’রা (ইয়াবা ব্যবসায়ীরা) এখন গা-ঢাকা দিয়েছেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, ইয়াবার টাকায় টেকনাফের লেদা, নেঙ্গরবিল, পৌরসভার চৌধুরীপাড়া, দক্ষিণ জালিয়াপাড়া, মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, ডেইলপাড়া, শিলবনিয়াপাড়ায় রাজপ্রাসাদের মতো গড়ে উঠেছে সারি সারি বাড়ি। তবে এসব বাড়ি এখন খালি পড়ে আছে, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বাড়ির মালিক মাদক ব্যবসায়ীরা। অভিযান এড়াতে বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে অন্যত্র বসবাস করছেন তারা। মাদকের টাকায় বানানো এই রাজপ্রাসাদ পাহারা দিতে তারা বসিয়েছেন সিসি ক্যামেরা। আবার কেউবা বাড়িতে রেখে গেছেন গরিব কোনো নিকটাত্মীয়কে।

টেকনাফের মৌলভীপাড়ায় রাস্তার পূর্বে পাশে বাড়ি বানিয়েছেন ইয়াবা ব্যবসায়ী আবদুর রহমান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে মৌলভীপাড়ায় সবার শীর্ষে তার অবস্থান। এলাকায় সবাই তাকে ‘বাবা’ নামে চেনেন। সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে আবদুর রহমান নিজের বাড়িতে থাকছেন না। তার আরেক ভাই একরামুল হোসেনও তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী। তারা দুজনই টেকনাফের মৌলভীপাড়ার হাজী ফজল আহমদের ছেলে।

পুলিশ ও সীমান্ত এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, ইয়াবা ব্যবসা করে সাত বছরে কোটিপতি হয়েছেন আবদুর রহমান। টেকনাফের মৌলভীপাড়ার ঠিক পেছনে নাফ নদী দিয়ে মিয়ানমার থেকে নৌকায় করে ইয়াবার চালান এনে খালাস করতেন তিনি। তারপর সেই ইয়াবার চালান পৌঁছে দেওয়া হয় কক্সবাজার শহর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। ইয়াবা সরবরাহের জন্য তার রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ৮ জুলাই (শুক্রবার) ভোরে টেকনাফ থানার পুলিশের হাতে আটক হন আবদুর রহমান। এর আগে কক্সবাজার জেলা ডিবি পুলিশের হাতে আটক হয়ে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। পরে আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় ইয়াবা ব্যবসা শুরু করে। তার বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসা, হত্যা, হামলা, সরকারি কাজে বাধা, মারপিটসহ অসংখ্য মামলা রয়েছে।

এদিকে আরেক গডফাদার একরাম হোসেন সাত বছর আগেও ছিলেন বেকার যুবক। সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে মিয়ানমারের মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার গড়ে ওঠে সম্পর্ক। সেই সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে। ইয়াবা চোরাচালানের টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে একরাম হোসেনের একটি চক্র রয়েছে।

২০১১ সালের দিকে টেকনাফের একজন প্রভাবশালী ইয়াবা গডফাদারের (এমপি বদি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর) নজরে পড়ে একরাম হোসেন। তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। সাত বছরে ইয়াবার ব্যবসা করে বিপুল টাকার মালিক হয়েছেন তিনি।

স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানায়, গত সাত বছরে একরাম হোসেন নামে-বেনামে শহরে দুটি ভবন, জমি, ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কারসহ বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হয়েছে। সূত্রের দাবি, মাদকবিরোধী অভিযান যে শুরু হবে, এ খবর আগে থেকেই পেয়ে যান এবং তারপরই আত্মগোপনে চলে যান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ভাই মুজিবুর রহমান, ফয়সাল ও শফিকের রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি রয়েছে টেকনাফের জালিয়াপাড়ায়। বদির আরেক ভাই আবদুস শুক্কুর বাড়ি বানিয়েছেন টেকনাফের অলিয়াবাদে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি মাদক ব্যবসায়ীদের নতুন ও পুরনো তালিকায় তাদের নাম রয়েছে। এছাড়াও তালিকায় নাম রয়েছে টেকনাফের নুরুল হুদা, মো. জোবাইয়ের, নুরুল বশর নুরশাদ, মো. সালমান, মো. হাসান আলী, বদির ফুফাতো ভাই কামরান হাসান রাসেল, নূর মোহাম্মদসহ অনেকের। বদির বেয়াই আকতার কামাল ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের পর তারা সবাই অন্যত্র রাত কাটাচ্ছেন। ইয়াবা ব্যবসার কোটি কোটি টাকা দিয়ে বানানো তাদের বাড়িগুলো এখন শূন্য পড়ে আছে। ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ভয়ে তালিকাভুক্ত এই ইয়াবার ‘বাবা’রা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।

শুক্রবার সকালে টেকনাফের পৌরসভার তিনটি গ্রামে পুলিশ অভিযান চালায়।

পুলিশের ভাষ্যমতে, কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে বেশ কয়েকটি গ্রামে ইয়াবার টাকায় ‘রাজপ্রাসাদে’র মতো বাড়ি বানিয়েছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। মাদক ইয়াবা দেশের যুবসমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে সরকারের নির্দেশে সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার সকালে কক্সবাজারের টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রনজিত কুমার বড়ুয়া ও পরিদর্শক রাজু আহমদের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল টেকনাফ পৌরসভার চৌধুরীপাড়া, জালিয়াপাড়া, দক্ষিণপাড়া গ্রামে অভিযান চালানো হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ সময় অর্ধশতাধিক বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। তবে মাদক ব্যবসায়ীরা বাড়িতে না থাকায় তাদের কাউকেই আটক করা যায়নি। অভিযান চলাকালে টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়ার ইয়াবা ব্যবসায়ী ১১ মামলার পলাতক আসামি মো. জোবাইর, তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হক, মো. সালমান, মো. হাসান আলী, রেজাউর করিম রেজা, মো. আবদুল্লাহ ও তার ভাই মো. জব্বারের বাড়িতে তল্লাশি করে পুলিশ।

পুলিশের সূত্র জানায়, মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারত ও ওমরা পালনের নামে সৌদি আরবে পালিয়ে গেছেন। অনেকে ট্রলারযোগে সমুদ্রেপথে মিয়ানমারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছেন।